ছেলের সামনে বাবাকে হত্যা: খুনি ‘ক্রসফায়ারে’, গডফাদার গ্রেপ্তার
2021.05.21
ঢাকা

সাবেক সংসদ সদস্য এম. এ. আউয়ালের ‘নির্দেশে’ রাজধানীর পল্লবীতে গত রোববার শিশুপুত্রের সামনে বাবা শাহিন উদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যাকারীদের অন্যতম মো. মানিক শুক্রবার র্যাবের সাথে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
শুক্রবার ভোর রাতে মিরপুর রূপনগরের ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় এই ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনাটি ঘটে বলে বেনারকে জানিয়েছেন র্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন।
শাহিন-হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে শাহিন উদ্দিনকে যে দুজন সবশেষে কোপাচ্ছে তাদের একজন মানিক। সে সাবেক সাংসদ আউয়ালের সন্ত্রাসী কর্মী, যে গত ১৫ বছর ধরে তাঁর সমর্থন পেয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল।”
শাহিন হত্যাকারীরা পল্লবীর ইস্টার্ন হাউজিংয়ে অবস্থান করছে এমন সংবাদ পেয়ে বৃহস্পতিবার রাতে র্যাবের টহল দল সেখানে গেলে “সন্ত্রাসীরা আমাদের সদস্যদের ওপর গুলি চালায়,” জানিয়ে তিনি বলেন, “আত্মরক্ষার্থে আমাদের সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালায়।”
“গোলাগুলির এক পর্যায়ে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। তবে ঘটনাস্থলে আমাদের সদস্যরা একজনের লাশ খুঁজে পায়। নিহতের পরিচিতি শনাক্ত করে আমরা জানতে পারি, সে শাহিন উদ্দিনের অন্যতম হত্যাকারী মানিক,” বলেন খন্দকার আল মঈন।
শাহিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক সাংসদ এম. এ. আউয়ালসহ এ পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ঘটনার সাথে জড়িত অন্যদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
গ্রেপ্তার সাবেক এম.পি আউয়ালের পল্লবী এলাকার আলীনগরে আবাসন ব্যবসা রয়েছে বলে জানান খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, “সেখানে তিনি বিভিন্ন মানুষের জমি ক্রয় করে বিক্রি করেন। মানিকসহ এই সন্ত্রাসী গ্রুপ জমির মালিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে অল্প দামে আউয়াল সাহেবের ব্যবসার জন্য জমির ব্যবস্থা করে দিত।”
তিনি জানান, আলীনগর এলাকায় আউয়ালের জমির কাছে নিহত শাহিনের অনেক জমি রয়েছে। কিন্তু শাহিন ওই জমি বিক্রি করতে চাননি। তা ছাড়া, অন্যদেরও জমি বিক্রি না করতে পরামর্শ দিয়ে আউয়ালের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
“সেকারণেই শাহিনকে আব্দুল আউয়ালের সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা কুপিয়ে হত্যা করেছে,” জানান গণমাধ্যম শাখার পরিচালক।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, রোববার বিকেলে শাহিন তাঁর সাত বছরের ছেলে মাশরাফিকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে বের হন।
মাশরাফি সাংবাদিকদের জানায়, বাবার সাথে ঘোরার সময় সুমন নামে এক যুবক শাহিনকে ফোন করে পল্লবীর ৩১ নম্বর রোডে দেখা করার কথা বলে।
সেখানে পৌঁছানোর পর মাশরাফিকে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে শাহিনের সাথে বাদানুবাদে জড়ায় ওই এলাকার মাস্তান হিসাবে পরিচিত সুমন। এক পর্যায়ে সুমনসহ আরও ছয়-সাতজন শাহিনকে লাথি মেরে মোটরসাইকেল থেকে ফেলে দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকে।
প্রাণ রক্ষায় শাহিন পাশের একটি বাড়ির গ্যারেজে আশ্রয় নিলে সন্ত্রাসীরা সেখানে ঢুকে তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে।
এই হত্যাকাণ্ডের দায়ে নিহত শাহিনের মা আকলিমা বেগম পল্লবী থানায় আউয়ালের বিরুদ্ধে মামলা করেন। বৃহস্পতিবার সকালে তাঁকে ভৈরব থেকে গ্রেপ্তারের পর শুক্রবার আদালতে হাজির করে চার দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
‘হত্যা করে অপরাধ বন্ধ করা যাবে না’
এম এ আউয়াল তরীকত ফেডারেশনের মহাসচিব থাকাকালে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ১৪-দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে লক্ষ্মীপুর-১ আসনে নৌকা প্রতীকে সাংসদ হন।
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে তাঁকে তরীকত ফেডারেশনের মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দিলে তিনি ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি এর চেয়ারম্যান।
রাজনৈতিক এই গডফাদারের নির্দেশে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর খুনিদের একজনকে হত্যা করা হলো।
“আমাদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা যেটাকে ‘ক্রসফায়ার’ অথবা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বলেন সেটি আসলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এটি দেশের মানুষ বোঝে। সুতরাং, এভাবে ‘ক্রসফায়ার’ বলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেয়া যাবে না,” বেনারকে বলেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান।
তিনি বলেন, “যখনই একজন অপরাধী এভাবে ক্রসফায়ারে মারা যায় তখন মানুষ মনে করে যে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে এবং বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতেই এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।”
“দেশে ‘ক্রসফায়ার’ নামক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার সময় থেকে আমরা বলে আসছি হত্যা করে সমাজে অপরাধ বন্ধ করা যাবে না। ‘ক্রসফায়ার’ যদি কার্যকর পন্থা হতো তাহলে বাংলাদেশে আর কোনো অপরাধী থাকত না। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না,” বলেন নূর খান।
তাঁর মতে, “এই ‘ক্রসফায়ার’ দেখিয়ে অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, অধিকার হরণ করা হচ্ছে,” তাই “যত তাড়াতাড়ি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে এবং প্রচলিত বিচারব্যবস্থার ওপর পুরোপুরি আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে, ততই দেশের মঙ্গল হবে।”
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত, প্রথম চার মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ২৪টি।