অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদেও বিচারবহির্ভূত হত্যায় মানবাধিকারকর্মীদের উদ্বেগ
2025.03.03
ঢাকা

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিরোধী মত দমনে হেফাজতে মৃত্যু ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, ৫ আগস্ট অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তবর্তী সরকারের মেয়াদেও একইরকম কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, অন্তবর্তীকালীন সরকারের গত ৮ আগস্ট থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন অন্তত ১৯ জন।
এর মধ্যে শুধু গত জানুয়ারি মাসেই মারা গেছেন ৫ জন।
“এসব ব্যক্তি হয় যৌথ বাহিনী বা পুলিশের সাথে ‘গুলি বিনিময়’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে, অথবা হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনে আহত হওয়ার পর হাসপাতালে মৃত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে,” বেনারনিউজকে বলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির।
অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যুসহ অন্যান্য নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রশাসনের প্রচেষ্টার রূপরেখা তুলে ধরে সম্প্রতি একটি বিবৃতি দিয়েছেন।
“জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবাধিকার সমুন্নত রাখা বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের উদ্দেশ্যে সরকার বেশ কিছু কমিশন করেছে, এসব কমিশনে দেশের স্বনামধন্য বেশ কিছু অধিকারকর্মী কাজ করছেন,” বলেন তিনি।
ওই বিবৃতিতে বলা হয় “সরকার ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করেছে।”
“বেশিরভাগ কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ, অপরাধ ব্যবস্থাপনা এবং বিচারিক পদ্ধতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি সুযোগ নির্মূল করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলির সাথে অর্থপূর্ণ সংলাপ করবে,” বিবৃতিতে শফিকুল বলেন।
সোচ্চার মানবাধিকার কর্মীরা
এদিকে, অন্তবর্তী সরকারের এমন প্রতিশ্রুতির মধ্যেই বেশ কয়েকটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অধিকারকর্মীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা এইচআরডব্লিউ জানুয়ারিতে এক প্রতিবেদনে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিরচেনা পদ্ধতি অবলম্বনের অভিযোগ এনেছে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
“দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী হাসিনা প্রশাসনের নির্যাতনের সেই পরিচিত ধরণগুলি অনুকরণ করছে,” বলছে এইচআরডব্লিউ'র প্রতিবেদন।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর পরিচালক এএসএম নাসিরউদ্দিন এলান অন্তবর্তী সরকারকে এসব ঘটনায় জোর পদক্ষেপ নিতে তাগিদ দেন।

“বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা কোনওভাবে প্রত্যাশিত নয়। এসব হত্যা থামাতে হবে। আমরা সরকারকে আহবান জানাই এসব ঘটনায় জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা হোক,” বলেন নাসিরউদ্দিন এলান।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলার সময় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সম্প্রতি দুজন যুবক মারা যাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা অপারেশন ডেভিল হান্টের বিষয়েও নজর রাখছি। আমরা এসব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও ন্যায়বিচার দাবি করছি। সেটা যে বাহিনীই হোক, অভিযানের সময় তাদের অবশ্যই মানবাধিকার গাইডলাইন মেনে চলতে হবে।”
গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া 'অপারেশন ডেভিল হান্টে' প্রায় সাড়ে ১২ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, অপারেশন ডেভিল হান্টের নামে মূলত তাঁর দলের হাজারো নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
যেসব হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ
গত ৩১ জানুয়ারি রাতে কুমিল্লায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির যুব সংগঠন যুবদলের এক স্থানীয় নেতাকে যৌথবাহিনীর হেফাজতে নিয়ে বেদম নির্যাতনের পর মারা গেলে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে।
যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামকে মধ্যরাতে তার বাসা থেকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর হেফাজতে নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়। পরিবারের অভিযোগ নির্মম নির্যাতনে তৌহিদুলের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসকদের করা ময়নাতদন্তেও তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
নিহতের ভাই আবুল কালাম বেনারকে বলেন, তাঁর ভাইয়ের শরীরের কোমর থেকে পা পর্যন্ত আঘাতের চিহ্ন ছিল। এছাড়াও তলপেট, বুক, পিঠে ও গলায় আঘাতের দাগ ছিল।
মৃত্যুর একদিন পর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর থেকে এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়। ঘটনার পর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সেনাবাহিনীর ক্যাম্প কমান্ডারকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয় বলে জানায় আইএসপিআর। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়ে তদন্ত চলমান থাকায় অগ্রগতি জানাতে পারেনি আইএসপিআর।
নিহত তৌহিদুলের ভাই আবুল কালাম বেনারকে বলেন, সবাই সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দিয়েছে। কোনও দৃশ্যমান পদক্ষেপ আমরা এখনো পর্যন্ত দেখিনি। আমরা পাঁচজনকে অভিযুক্ত করেছি। আরো কয়েকজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে।
“এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। তদন্তের অগ্রগতি কি হয়েছে, সেটাও আমরা জানি না। আমরা থানায় খবর নিতে গেলে তদন্ত কর্মকর্তা বলতে থাকেন, তদন্ত চলছে। কিন্তু এই তদন্ত কবে নাগাদ শেষ হবে সেটা একমাত্র আল্লাহই জানেন,” বলেন আবুল কালাম।
এদিকে ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে যৌথ বাহিনীর অভিযানে 'গুলি বিনিময়ের' ঘটনায় নিহত হন দুই যুবক। এদের একজন মো. জুম্মান (২৬) ও আরেকজন মিরাজ হোসেন (২৫)।
এ ঘটনার পর আইএসপিআরের (আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর)সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অভিযান চলাকালে যৌথ বাহিনী সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে দুইজন। পরে যৌথ বাহিনী সদস্যদের পাল্টা গুলিতে জুম্মান ও তার সহযোগী মিরাজ হোসেন নিহত হন।
গুম-খুন বিষয়ক ঘটনা তদন্তে গঠিত গুম কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বেনারকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশে যেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হওয়ার কথা, সেখানে আমরা দেখছি আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি-ছয় মাসের মধ্যে এসব ঘটনা বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, “এসব ঘটনা থামাতে সরকার দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিচ্ছে না। প্রত্যেকটা হেফাজতে মৃত্যু ও বিচারবহির্ভূত হত্যার পরপরই আমাদের গুলিবিনিময় ও বন্দুকযুদ্ধের সেই পুরানো গল্প বলা হচ্ছে।”
“সেই পুরনো ধারাতেই এসব হত্যাকান্ড সংঘটিত হচ্ছে। গত ছয় মাসে যা ঘটেছে, সেটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য না। অন্তবর্তীকালীন সরকার যার ওপর প্রতিষ্ঠান সংস্কারের দায়িত্ব বর্তেছে তাঁদের সময়কালে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কোনওভাবেই প্রত্যাশিত নয়,” বলেন নুর খান লিটন।
তিনি বলেন, “অন্তবর্তীকালীন সরকার এসব ঘটনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও আমরা এখনো পর্যন্ত একটি ঘটনাতে কারও বিরুদ্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। এটা উদ্বেগজনক ও হতাশাজনক।”