পুলিশের অভিযানে আত্মঘাতী নারী জঙ্গিসহ দুজন নিহত
2016.12.24
ঢাকা থেকে
ঢাকার আশকোনা এলাকায় একটি বাড়িতে পুলিশের অভিযানে আত্মঘাতী এক নারী জঙ্গি ও আরেক কিশোর নিহত হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছে নিহত নারী জঙ্গির সঙ্গে থাকা এক শিশু, যার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। পুলিশের জঙ্গি বিরোধী এই অভিযানে চারজন আত্মসমর্পণ করে।
পুলিশ শুক্রবার মধ্যরাত থেকেই বাড়িটি ঘিরে রাখে। প্রায় ১৬ ঘণ্টার এই অভিযানকে ‘অপারেশন রিপল-২৪’ নাম দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।
পুলিশ জানিয়েছে, আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গি ও সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা ও তাঁদের সাত বছরের মেয়ে রয়েছে। অন্য দুজন হচ্ছে; পলাতক জঙ্গি মঈনুল ওরফে মুসার স্ত্রী তৃষ্ণা ও তাঁর চার মাস বয়সী মেয়ে।
আর বাসার ভেতরে যে কিশোরের দেহটি পড়ে ছিল তার নাম আফিফ কাদরী। আজিমপুরে নিহত জঙ্গি তানভীর কাদরীর যমজ দুই ছেলের একজন আফিফ। আফিফের যমজ ভাই তাহরীম কাদরী ও মা শারমীন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছে।
আর নিজের শরীরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত নারী জঙ্গি জনৈক সুমন ওরফে সাগরের স্ত্রী। আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার চার বছরের মেয়েটির নাম সাবিনা, তার বাবার নাম ইকবাল। তবে সুমন বা ইকবালের বিষয়ে পুলিশ বিস্তারিত কিছু জানায়নি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেলা সোয়া তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে যান। বেলা পৌনে চারটার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ওই বাসার ভেতরে অসংখ্য তাজা গ্রেনেড, বোমা পড়ে আছে। অভিযান পরিসমাপ্ত হলেও ভেতর থেকে এগুলো পরিষ্কার করার কাজ চলবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ডিএমপি কমিশনার অভিযানের তথ্য তুলে ধরেন। নিউজরুম ফটো।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “কিশোরের দেহটি ভেতরে রেখেই গতকাল বিকেলে তাঁরা ফ্ল্যাটটি তালা মেরে বের হয়ে এসেছেন। ভেতর থেকে তীব্র গ্যাসের গন্ধ বের হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে গ্যাসের লাইনে কোনো লিকেজ হয়েছে বা করা হয়েছে।”
তিনি জানান, ওই বাসায় রাতে আলো জ্বালিয়ে অভিযান চালানো ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেছেন তাঁরা। তাই রোববার দিনের আলোয় অভিযান চালানো হবে।
গুলশানের হলি আর্টিজানে ১ জুলাই হামলার পর গত ছয় মাসে আটটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে মোট ২৮ জন ‘নব্য জেএমবি’র সদস্য নিহত হয়েছে।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঢোকার উল্টোদিকের রাস্তা দিয়ে হজক্যাম্প পেরিয়ে এক কিলোমিটার গেলেই আশকোনার পূর্ব পাড়া। সেখানকার আল বাছির জামে মসজিদের তোরণ দিয়ে গলিতে ঢুকে তিনটি বাড়ি পেরোলেই হাতের ডানে সূর্য ভিলা নামক বাড়িটি।
কাতার প্রবাসী মো. জামাল হোসেনের নির্মাণাধীন এই তিন তলা বাড়ির নিচ তলার একমাত্র ফ্ল্যাটটিতে পুলিশ অভিযান চালায়। এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় রয়েছে আরও ছয়টি ফ্ল্যাট। তিন তলার একটি ফ্ল্যাটে বাড়ির মালিকের স্ত্রী চায়না বেগম তার এক মেয়েকে নিয়ে থাকেন।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলেন, গুলশান হামলার সঙ্গে যুক্ত এক জঙ্গি মঈনুল ওরফে মুসার খোঁজে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি দল ওই এলাকায় অভিযান চালাচ্ছিল। পুলিশ প্রথমে সূর্য ভিলার পাশের বাড়িতে অভিযান চালায়। কিন্তু সেখানে কোন জঙ্গির অবস্থান না থাকায় সূর্য ভিলায় অভিযান চালায় তারা।
অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, ১৫-২০ দিন ধরেই ওই এলাকায় জঙ্গি মুসার অবস্থান সম্পর্কে তাদের কাছে খবর ছিল। শুক্রবার রাত ১২টার দিকে তাঁরা নিশ্চিত হন যে সূর্য ভিলা নামের বাড়িটিতেই জঙ্গিরা রয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বেনারকে বলেন, মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহারকে আত্মসমর্পণ করাতে তাঁর মা ও ভাইকে নিয়ে আসা হয়। তাঁরাও মাইকে জেবুন্নাহারকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন।
আত্মঘাতী নারী জঙ্গি
পুলিশ জানায়, চার নারী আত্মসমর্পণ করার পর ভেতরে যারা ছিল তাদের আত্মসমর্পণ করার জন্য এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। এরপর আবার মাইকের মাধ্যমে তাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান করে সময় বেঁধে দেওয়া হয়। শিশুটিকে সামনে দিয়ে নারী ও কিশোরকে সারিবদ্ধভাবে বেরিয়ে আসার জন্য বলা হয়। তাদের জন্য প্রধান ফটকটিও খুলে দেওয়া হয়।
আত্মঘাতী নারী জঙ্গির সঙ্গে থাকা আহত শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। স্টার মেইল
পুলিশ আরও জানায়, বেলা ১২ টা ২৩ মিনিটের দিকে একটি শিশুকে বাম হাতে ধরে নিয়ে এক নারী দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন। পুলিশ কর্মকর্তারা ‘থামুন থামুন’ বলে ওই নারীকে দুই হাত ওপরে তুলে বের হতে বলেন। কিন্তু সে কথা না শুনে সাত থেকে আট কদম এগিয়ে এসে কোমরে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। এর পরপরই নারী ও শিশুটি ঘটনাস্থলে পড়ে যান। শিশুটি নড়াচড়া করছে দেখে পুলিশ সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়।
আট অভিযানে নিহত ২৮
গুলশান হামলার পর প্রথম অভিযান হয় ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি বাড়িতে। এতে ৯ জন নিহত হন। এরপর ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে আরেকটি জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে নিহত হয় নব্য জেএমবির কথিত সামরিক শাখার প্রধান ও হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার মূল সমন্বয়ক তামিম চৌধুরীসহ ৩ জন।
এর পাঁচদিনের মাথায় ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রূপনগরে একটি বাসায় পুলিশের অভিযানে নিহত হয় মেজর (অব) জাহিদুল ইসলাম।
এরপর ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আজিমপুরে আরেক অভিযানে নব্য জেএমবির আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও ব্যাংক কর্মকর্তা তানভীর কাদেরী নিহত হয়।
গত ৮ অক্টোবর গাজিপুরে দুটি, টাঙ্গাইলে একটি ও আশুলিয়া একটি বাড়িতে র্যাব ও পুলিশ পৃথক অভিযান চালায়। এসব অভিযানে নিহত হয় মোট ১২ জন। সর্বশেষ গতকাল নিহত হয়েছে দুজন।