কওমি মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে লেখা উপন্যাস নিষিদ্ধ করেছে সরকার

প্রাপ্তি রহমান
2020.08.31
ঢাকা
200901_BD-book-banned-photo-replace-1000.jpg ঢাকার একটি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছে। ১৯ এপ্রিল ২০০৯।
[এপি]

আপডেট: ৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ইস্টার্ন সময় দুপুর ০১:৩০

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে—এই বিবেচনায় কওমি মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘বিষফোঁড়া’ নিষিদ্ধ করেছে সরকার।

বইটি ‘কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে’ গোয়েন্দাদের এমন তথ্যের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

এদিকে বইটি নিষিদ্ধ করার আগে লেখক বা প্রকাশককে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে বেনারকে জানান বইটির প্রকাশনা সংস্থা জংশনের কর্ণধার মোশাররফ মাতুব্বর।

তিনি বলেন, “বৃহস্পতিবার এক সাংবাদিকের ফোনে আমি প্রথম শুনতে পেলাম যে, বইটা নিষিদ্ধ হয়েছে।”

গত ২৪ আগস্ট সাইফুল বাতেন টিটোর লেখা ‘কওমি মাদ্রাসার শিশু ধর্ষণ উপাখ্যান- বিষফোঁড়া’ উপন্যাসটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এক গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।

‘বিষফোঁড়া’ উপন্যাসটির বিষয়বস্তু “দেশের শান্তিশৃঙ্খলা পরিপন্থী” উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “ইতোমধ্যে বইটি জননিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত হওয়ায় বাংলাদেশে তা নিষিদ্ধ করা হলো।”

এই নিষেধাজ্ঞা “অবিলম্বে কার্যকর করা হবে,” বলেও জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

সরকার কেন উপন্যাসটির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করছে জানতে চাইলে জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু বকর ছিদ্দীক শুক্রবার বেনারকে বলেন, “বইটি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে বলে আশঙ্কার কথা গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আমাদের জানানো হয়েছিল।”

তবে বইটি নিষিদ্ধ করার আগে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আলাদাভাবে কোনো কমিটি করা হয়নি, বরং তাঁরা নিজেরা পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জানিয়ে আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, “আমরা নিজেরা বইটি পড়ে দেখেছি। গোয়েন্দা সংস্থার আশঙ্কা সত্য বলে মনে হয়েছে।”

১২৯ পৃষ্ঠার ‘বিষফোঁড়া বইটিতে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসায় শিশুদের ওপর ঘটনা নির্যাতনের বিবরণ রয়েছে। উপন্যাসাটি বেনার প্রতিবেদক পড়েছেন।

এতে দেখা যায় কওমি মাদ্রাসার একটি এতিম শিশু শিক্ষকদের অতিরিক্ত যৌন ও অন্যান্য ধরনের নির্যাতনে শেষ পর্যন্ত মারা যায়। ওই শিশু ছাড়াও উপন্যাসটিতে শিক্ষকদের দ্বারা আরো কয়েকটি শিশুর ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা দেখানো হয়।

“বইটিতে অনাথ শিশুদের প্রতি মাদ্রাসায় যে অবিচার সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়,” বেনারকে বলেন বইটির প্রকাশক মোশাররফ মাতুব্বর।

নিষিদ্ধ ঘোষিত ‘বিষফোঁড়া’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ।
নিষিদ্ধ ঘোষিত ‘বিষফোঁড়া’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ।
[বেনারনিউজ]
‘নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য আদালতে যাব’

“বাংলাদেশে লেখক-প্রকাশকদের বিরুদ্ধাচরণের সংস্কৃতি পুরোনো,” মন্তব্য করে বিষফোঁড়া বইটির লেখক সাইফুল বাতেন টিটো বেনারকে বলেন, “বইয়ে এমন কিছু নেই, যার কারণে বইটির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যায়।”

বইটিতে ‘জননিরাপত্তার জন্য হুমকি’ বিবেচিত হতে পারে এমন কিছুও নেই দাবি করে তিনি বলেন, “আমি যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে উপন্যাসটি লিখেছি। বছর খানেক গবেষণার পর বইটি আলোর মুখ দেখে।”

বইটির শুরুতে লেখক সাইফুল বাতেন টিটো লেখেন, পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদনে মাদ্রাসায় শিশুদের ওপর নির্যাতনের খবর তিনি পড়েছেন। এরপর বিভিন্ন মাদ্রাসায় গিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে গবেষণামূলক উপন্যাসটি লেখেন তিনি।

“এটি কোনোভাবেই ইসলামবিরোধী কোনো উপন্যাস নয় এবং কওমি মাদ্রাসার বিরুদ্ধেও নয়,” বইটির লেখকের কথা অংশে বলেন সাইফুল বাতেন টিটো।

তিনি বলেন, উপন্যাসটি “বাংলদেশে প্রচলিত এক কূপমণ্ডূক পশ্চাৎপদ শিক্ষাব্যবস্থার (মাদ্রাসার) ভেতর জঞ্জাল ও নানা অসংগতি নিয়ে লেখা।”

বিষফোঁড়া উপন্যাসটি গত ফেব্রুয়ারিতে একুশে বইমেলায় প্রথম প্রকাশিত হয় বলে বেনারকে জানান মোশাররফ মাতুব্বর।

বইটিতে ‘স্পর্শকাতর’ কোনো উপাদান আছে কি না তা দেখার জন্য মেলার শুরুতে স্টল থেকে পুলিশ বইটির কপি নিয়ে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, “পরে স্পর্শকাতর কিছু না পেয়ে তারা আমাদের বই বিক্রিতে আর বাধা দেয়নি।”

তবে প্রকাশের পর থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে “বইটির বিরুদ্ধে প্রচার শুরু হয়,” বলে জানান তিনি।

গত মেলায় বইটির প্রায় পাঁচশ কপি বিক্রি হয়েছে জানিয়ে মোশাররফ মাতুব্বর বলেন, “নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আরজি নিয়ে আমরা আদালতে যাব। এর ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত বইটির বিক্রি বন্ধ থাকবে।”

তিন দশকে অন্তত পাঁচটি বই নিষিদ্ধ

ইসলাম অবমাননা বা অশ্লীলতার অভিযোগে নব্বইয়ের দশক থেকে এ পর্যন্ত সরকার অন্তত পাঁচটি বই নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এছাড়াও বইমেলায় স্টল বন্ধ করে দেওয়া কিংবা প্রকাশক গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে।

১৯৯২ সালে ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার ঘটনা নিয়ে লেখা নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরীনের ‘লজ্জা’ উপন্যাস ‘ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট হতে পারে,” এই অজুহাতে নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৯৩ সালে।

এছাড়াও অশ্লীলতার দায়ে তসলিমা নাসরীনের ‘আমার মেয়েবেলা’ ১৯৯৯ সালে নিষিদ্ধ হয়। আত্মজীবনীমূলক এই বইটিতে লেখক তাঁর নিজের ওপর ঘটে যাওয়া কয়েকটি নিপীড়নমূলক ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন।

এর পর মৌলবাদীদের হুমকির মুখে লেখক দেশ ছেড়ে চলে যান, এখনো তিনি দেশের বাইরে।

নিষিদ্ধ বই এর তালিকায় হ‌ুমায়ূন আজাদের নারীবাদ বিষয়ক প্রবন্ধের বই ‘নারী; ও বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিষয়ক উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ রয়েছে।

১৯৯২ সালে বই দুটি নিষিদ্ধ করা হয়। পরে নারী বইটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। সর্বশেষ নিষিদ্ধ হয়েছে ‘বিষফোঁড়া’।

এর আগে ১৯৮৮ সালে ইসলাম অবমাননার দায়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বৃটিশ লেখক সালমান রুশদীর লেখা স্যাটানিক ভার্সেস, যা দেশে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল।

সরকারিভাবে বই নিষিদ্ধ না করলেও বইয়ের মাধ্যমে ধর্ম অবমাননাকর বই প্রকাশের অভিযোগে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি বই মেলায় বদ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয় সরকার।

একই সঙ্গে ওই প্রকাশনীর বেশ কয়েকটি বই জব্দ করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিকসহ তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

একই অভিযোগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে গার্ডিয়ান পাবলিকেশনসের প্রকাশক নূর মোহাম্মদকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার দাবি

‘বিষফোঁড়া’ উপন্যাসটি নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। বইটির লেখক সাইফুল বাতেন টিটো ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গবেষণা সেলের সদস্য।

“মৌলবাদীদের তুষ্ট করার জন্য” উপন্যাসটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে মন্তব্য করে শুক্রবারে দেওয়া বিবৃতিতে নিকট অতীতে পাঠ্যপুস্তক থেকে সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য লেখকদের রচনা বাদ দেবার ঘটনার উল্লেখ করে বলা হয়, এসবের মাধ্যমে “মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে।”

“আমাদের গণমাধ্যমে অহরহ আবাসিক কওমি মাদ্রাসায় শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনসহ নানাবিধ শারীরিক নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে,” জানিয়ে বিবৃতিতে মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতনের বিষয় তদন্ত করতে উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠনের পাশাপাশি ‘বিষফোঁড়া’ উপন্যাসটি নিষিদ্ধের ঘোষণা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসাগুলোর সংগঠন হেফাজতে ইসলাম সরকারের মিত্র বলে পরিচিত।

২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার মতিঝিলে সমাবেশ ডেকে সরকার পতনের ডাক দিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। হাজার হাজার মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও হেফাজত কর্মীদের সে সময় কঠোরভাবে দমন করে সরকার। এরপর থেকে ধীরে ধীরে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সখ্য গড়ে ওঠে।

হেফাজতে ইসলামের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবই থেকে প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দিয়ে অন্য লেখকদের পদ্য ও গদ্য যুক্ত করা হয়।

এ নিয়ে প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রতিবাদ করলেও সরকার তার অবস্থানে অনড় থাকে।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মাসকয়েক আগে সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে কওমি মাদ্রাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এর প্রতিক্রিয়ায় হেফাজতে ইসলাম প্রধান আল্লামা আহমদ শফীর সভাপতিত্বে ২০১৮ সালের নভেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ‘কওমি জননী’ উপাধতে ভূষিত করে কওমি মাদ্রাসার সংগঠনগুলো।

বাংলাদেশে বর্তমানে ছেলে শিশুদেরও যৌন নির্যাতনের অভিযোগে মামলা বেড়েছে এবং এর একটি অংশ কওমী মাদ্রাসা থেকে আসছে বলে বেনারকে জানান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলি মাহমুদা আক্তার।

তিনি বলেন, “একটা সময় ছেলে শিশুরা হয়রানির শিকার হলেও আদালতের শরণাপন্ন হতেন না অভিভাবকরা। এটা ফৌজদারি অপরাধ এবং এখন অনেক মামলা হচ্ছে।”

“ঘটনার শিকার শিশুদের বড় অংশ দরিদ্র পরিবারের, তাদের কেউ কেউ কওমী মাদ্রাসায় হয়রানির শিকার হয়েছে,” বলেন মাহমুদা আক্তার।

আপডেট: প্রতিবেদনের ছবি পরিবর্তন করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।