পোশাক শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব মালিকপক্ষের

জেসমিন পাপড়ি
2017.11.21
ঢাকা
171121-BD-garment-620.jpg বকেয়া বেতন দাবিতে বিজিএমইএ ভবনের সামনে সোয়ান গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিক্ষোভ। আগস্ট ১৬, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

শ্রমিক আন্দোলন শুরুর আগেই পোশাক শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে গার্মেন্টস মালিকরা। গার্মেন্টস শ্রমিক নেতারা মনে করেন, বেতন বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন রুখতেই মালিকেরা এ প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে মালিকপক্ষের এই প্রস্তাবকে স্বাগতও জানিয়েছেন তাঁরা।

গত বছরের ডিসেম্বরে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আশুলিয়ায় অসংখ্য কারখানায় কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেন শ্রমিকেরা। আন্দোলনরত বহু শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের ধরপাকড়ের ঘটনায় বিদেশি ক্রেতাদের চাপের মুখে পড়েন গার্মেন্টস মালিকরা। সেই চাপের ধারাবাহিকতায় বেতন বৃদ্ধির এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন শ্রমিক নেতারা।

মালিকদের প্রস্তাব প্রসঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বেনারকে বলেন, “পাঁচ বছর পর পর মজুরি পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। সে হিসেবে সর্বশেষ মজুরি নির্ধারণের চার বছর পরেই মালিকপক্ষ বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। তারা ভালো মানুষ বলেই সময়ের আগেই এ প্রস্তাব দিয়েছে।”

“মালিকেরা মজুরি নির্ধারণে একটি ওয়েজ বোর্ড গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। সরকার তো রেডিই আছে। মালিকদের প্রস্তাব পেয়ে আরও ভালো হলো। এখন আমরা সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে শিগগির ওয়েজ বোর্ড গঠন করব,” বলেন তিনি।

পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৪৪ লাখ পোশাক শ্রমিক রয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় এই শিল্প খাতে ১৯৮৫ সালে নিম্নতম মজুরি ছিল ৫৪২ টাকা। ১৯৯৪ সালে তা বাড়িয়ে ৯৩০ টাকা করা হয়। এর এক যুগ পর ২০০৬ সালে পোশাক শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি বাড়িয়ে ১ হাজার ৬৬২ টাকা করা হয়। এর চার বছর পরে ২০১০ সালে নিম্নতম মজুরি হয় ৩ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০১৩ সালে মজুরি কমিশন নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে ৫ হাজার ৩০০ টাকা। তবে প্রতিবার বেতন বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক আন্দোলন করতে হয়েছে শ্রমিকদের।

আর তাই চিরাচরিত নিয়ম ভেঙে শ্রমিকদের দাবির আগেই হঠাৎ মালিকদের বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবকে কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখছেন শ্রমিক নেতারা।

এ প্রসঙ্গে মাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান বেনারকে বলেন, “মালিকদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই। তবে এটা কতটুকু সদিচ্ছা প্রসূত ও কতটুকু শ্রমিকদের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্য সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে।”

তিনি বলেন, “ন্যায্য মজুরি নির্ধারণের একটি মাপকাঠির জন্য আমরা শ্রমিক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। আন্তর্জাতিক মান এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমরা ১৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের দাবি জানিয়ে আসছি। এখন মালিকেরা সেই দাবিকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য হয়তো নামমাত্র বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব দেবে।”

“আগে দেওয়ার নামে শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন পাওয়ার জন্য আন্দোলনের প্রস্তুতি রোখার কৌশল হতে পারে মালিকদের এই প্রস্তাব। তবে আমরা এখনো মজুরি নির্ধারণের মাপকাঠি নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের দাবি জানাচ্ছি,” বলেন রাজেকুজ্জামান রতন।

এই শ্রমিক নেতা বিষয়টির ব্যাখ্যা করেন এভাবে—“একজন শ্রমিক দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করলে তার কি পরিমাণ খাদ্য লাগে এবং তার খাদ্যের প্রয়োজনটুকু যদি আয়ের ৪৫ শতাংশ ধরা হয় তাহলে সে অনুযায়ী তার বেতন কত হতে পারে সেটা নির্ধারণ করতে হবে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, দৈনিক ২ ডলারের কম আয় করা ব্যক্তি দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে। তাহলে আমাদের শ্রমিকেরা কি কাজ করেও দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে? কাজ করে দারিদ্র্যসীমার ওপরে যেতে হলে পাঁচ সদস্যের পরিবার বিশিষ্ট একজন শ্রমিককে অন্তত দৈনিক ১০ ডলার আয় করতে হবে। আর সে অনুযায়ীই তাদের মাসিক বেতন নির্ধারণ করতে হবে।”

মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলন রোখার যে অভিযোগ শ্রমিক নেতারা এনেছেন তা অস্বীকার করেছে মালিকপক্ষ।

পোশাক মালিক শ্রমিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র সহসভাপতি এস এম মান্নান কচি এ প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন, “শ্রমিকদের স্বার্থ বিবেচনা করেই আমরা তাদের বেতন বাড়ানোর জন্য মজুরি বোর্ড গঠনের প্রস্তাব দিয়েছি। এর পেছনে কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই। এক বছর পরে দিলে আলাপ আলোচনা করতে করতে আরও ৬/৭ মাস সময়ে চলে যেতো, এ জন্য এক বছর আগেই আমরা প্রস্তাব দিয়েছি।”

বর্ধিত ন্যূনতম বেতন কত ধরা হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বর্তমান বাজার মূল্যায়ণ করে, আমাদের সক্ষমতা বিবেচনা করে সরকার, শ্রমিক নেতা, বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট সকলে সেটা নির্ধারণ করবে। এটা মালিকদের একার বিষয় নয়।”

“এখন বর্তমান বাজারের অবস্থা সরকার, শ্রমিক নেতারা সবাই জানে। মূল্যায়ন সে অনুযায়ীই করবে। এখানে শ্রমিকদের ফাঁকি দেওয়ার বিষয় না,” বলেন বিজিএমইএ নেতা মান্নান কচি।

এদিকে পোশাক শ্রমিকদের জন্য বেতন-ভাতা বাড়ানো নিয়ে সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এ বিষয়ে মজুরি কমিশন গঠনের প্রস্তাব তোলা হয়।

বৈঠকে শিল্প কারখানার পরিবেশ ও শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়াতে মজুরি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন।

শ্রমিকদের কল্যাণের কথা বলে বিদেশ থেকে বিভিন্ন এনজিওর আনা তহবিল একই উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হয় কি না সে বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয় বলে জানা যায়।

এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বলেন, “শ্রমিকেরা এখন চাকরির শুরুতে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা বেতন পান। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়ার প্রেক্ষিতে শ্রমিকদেরও বেতন-ভাতা আরেকটু বাড়ানো উচিত। এ ক্ষেত্রে মজুরি কমিশন গঠন করা যেতে পারে।”

মন্ত্রিসভায় শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার বিষয়টিও আলোচনায় হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী পোশাক খাতে যেসব এনজিও কাজ করে, তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে এনজিও-বিষয়ক ব্যুরোকে সচেতন থাকার নির্দেশ দেন। যাতে কোনো এনজিও বিদেশ থেকে টাকা এনে পোশাক খাতকে অস্থিতিশীল করতে না পারে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।