শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছে, শতাধিক পোশাক কারখানা ফেব্রুয়ারির বেতন দিতে পারেনি

রিয়াদ হোসেন
2024.04.04
ঢাকা
শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছে, শতাধিক পোশাক  কারখানা ফেব্রুয়ারির বেতন দিতে পারেনি সাভারের একটি গার্মেন্টস কর্মীদের আন্দোলনের দৃশ্য। ২১ জানুয়ারি ২০২৪।
[ মো: হাসান/বেনারনিউজ ]

ঈদুল ফিতরের মাত্র এক সপ্তাহ বাকি, তবে দেশের শতাধিক পোশাক কারখানার শ্রমিকরা এখনো ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন পাননি।  ফলে গাজীপুর, ধামরাই, সাভারসহ শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে গত কয়েক দিন ধরে কোনো না কোনো কারখানায় অসন্তোষ লেগেই আছে।

শিল্পাঞ্চল পুলিশ জানিয়েছে, গত তিন সপ্তাহে অন্তত ২০টি পোশাক ও বস্ত্র কারখানায় অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে।

শিল্পাঞ্চল পুলিশের মুখপাত্র (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) নূরানী ফেরদৌস দিশা বেনারকে বলেন, “৩ এপ্রিল পর্যন্ত গত তিন সপ্তাহে ২০টি পোশাক ও টেক্সটাইল কারখানায় অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে।  এছাড়া অন্তত ১০০ কারখানা কর্তৃপক্ষ ফেব্রুয়ারির পাওনা পরিশোধ করতে পারেনি।”

উল্লেখ্য, দেশের অন্যতম বড় পোশাক শিল্প অধ্যুষিত এলাকা গাজীপুর।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) গাজীপুরের উপমহাপরিদর্শক আহমেদ বেলাল বেনারকে বলেন, “গত এক মাসে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস মিলিয়ে কেবল গাজীপুর অঞ্চলেই ২০টির বেশি কারখানায় অসন্তোষের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।”

শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবারও তিনটি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।  এসব কারখানায় শ্রমিক সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি।

শিল্পাঞ্চল পুলিশ দুই সপ্তাহ আগে বেতন-ভাতা পরিশোধের সমস্যায় পড়তে পারে, এমন কারখানার তালিকা তৈরি করে।  ওই তালিকার একটি কপি বেনারের হাতে এসেছে।  তাতে দেখা যায়, পোশাক খাতের দুটি সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রায় দেড়শ কারখানার নাম রয়েছে তালিকায়।

শ্রমিক অসন্তোষ কখনো কখনো সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে।

বৃহস্পতিবার বকেয়া বেতনের দাবিতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় এসিএস টেক্সটাইল কারখানার শ্রমিকরা প্রায় দুই ঘণ্টা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। এতে মহাসড়কের উভয় প্রান্তে যানজটের সৃষ্টি হয়।

এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত এক পুলিশ সদস্য আহত হন।

শিল্পাঞ্চল পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান রাত ১০টায় বেনারকে বলেন, “শ্রমিকরা হঠাৎ করে ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করলে একজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।  তবে কোনো শ্রমিক আহত হয়েছেন কি না তা জানা নেই।  সন্ধ্যা ৭টার পর ওই এলাকায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।”

বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে গত পাঁচ দিন ধরে গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকার কেয়া নিট কম্পোজিট কারখানার শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখেছেন। ওই কারখানাটির চার হাজারের বেশি শ্রমিক অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন।  গত ২ এপ্রিল সন্ধ্যার পর শ্রমিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে, যাতে অন্তত দুই শ্রমিক আহত হন।

তাদের স্থানীয় শরিফ মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির ব্যবস্থাপক মো. মহব্বত আলী।

তিনি বলেন, “ওই কারখানার দুইজন শ্রমিক এই হাসপাতালে আহত হয়ে এসেছেন।  এর মধ্যে আইয়ুব আলী নামে এক শ্রমিকের মাথায় জখম রয়েছে, তাকে ভর্তি করা হয়েছে।  আরেক শ্রমিক মদিনা আক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন।”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কারখানার এক নারী শ্রমিক বেনারকে বলেন, “আমরা এখনো ফেব্রুয়ারির বেতন পাইনি।  আমরা কারখানায় অবস্থান করছিলাম, কোনো ভাঙচুর করিনি কিন্তু বাইরের লোক এনে আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে।”

এর আগে গত ২৯ মার্চ সাভারে পোশাক শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিনের নেতৃত্বে র‌্যালি বের হলে ‘স্থানীয় বাসিন্দাদের’ হামলায় ২১ জন আহত হন।  ওই ঘটনার দুই দিন পর গাজীপুরের চারটি স্থানে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

গাজীপুর ডিআইএফই অফিসের তথ্য অনুযায়ী, কেয়া নিট কম্পোজিট ছাড়াও গত তিন সপ্তাহ ধরে যেসব কারখানায় অসন্তোষ হয়েছে, সেই তালিকায় রয়েছে ক্রসলাইন অ্যাপারেলস লিমিটেড, মিফপিক অ্যাপারেল, সিজন ড্রেসেস, গুলশান স্পিনিং, টিএমজেড গ্রুপ, টিআরজেড গ্রুপের একটি কারখানা।

এছাড়া ঢাকার অদূরে ধামরাইয়ে ওডিসি ক্রাফ্ট প্রাইভেট লিমিটেডে বকেয়া বেতন পরিশোধ না করায় শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন।

কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু বকর সিদ্দিক খান বেনারকে বলেন, “শ্রমিকদের বেতনের একটি অংশ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দিতে পারিনি।”

এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ডিসেম্বর থেকে শ্রমিকদের বেতন বেড়েছে কিন্তু সেই অনুযায়ী ক্রেতাদের কাছ থেকে দর পাচ্ছি না। গত তিন মাস থেকেই বাড়তি বেতন দিতে হয়েছে, অথচ ক্রেতাদের কাছ থেকে তা পাইনি।”

ব্যাংকের কাছ থেকেও সহায়তা পাননি জানিয়ে তিনি বলেন, “ব্যাংক হঠাৎ করেই কঠোর হয়ে গেছে।”

গত অক্টোবর ও নভেম্বরে শ্রমিকদের নতুন মজুরি নিয়ে আন্দোলনের সময় চার শ্রমিক নিহত হন, যার বেশিরভাগই ছিল গাজীপুরে।

অসন্তোষ বাড়তে পারে

শ্রমিক নেতারা বলছেন, ঈদের আগে বাকি দিনগুলোতে বেতন-বোনাস নিয়ে অসন্তোষ আরও বাড়তে পারে। জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বেনারকে বলেন, “আমরা ধারণা করছি, ঈদের আগে যখন বোনাস ও মার্চের বেতন দেওয়া শুরু হবে, তখন আরও অনেক কারখানায় অসন্তোষ হতে পারে।”

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বেনারকে বলেন, “বকেয়া বেতনের দাবিতে বুধবারও গাজীপুরের একটি কারখানার শ্রমিকরা বিকেএমইএর ঢাকা অফিস ঘেরাও করেছে।”

তিনি বলেন, “আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে, অথচ পণ্যের দাম বাড়ছে না।  কোনো কোনো কারখানায় বরং কমছে।”

সরকারের কাছে রপ্তানিকারকদের নগদ প্রণোদনা সহায়তার চার হাজার কোটি টাকা আটকে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “অনেক কারখানা মালিক সাহায্য চাচ্ছে। এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০টি কারখানায় বেতন পরিশোধ নিয়ে সমস্যা আছে।”

এদিকে বৃহস্পতিবার গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী খাঁ পাড়া রোডের মাসকো-পিকাসো কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে শিল্প পুলিশের উপমহাপরিদর্শক মো. আজাদ মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, “শ্রমিকরা যাতে বেতন-ভাতা নিয়ে আনন্দের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পারেন, সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে। ”

অস্থির হয়ে শ্রমিকদের কারখানা ভাঙচুর থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি কারখানা কর্তৃপক্ষর সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করেছি।”

গ্রেপ্তার শ্রমিকদের মুক্তি দেওয়া আহ্বান

নতুন মজুরি কাঠামোর দাবি নিয়ে গত অক্টোবর ও নভেম্বরে আন্দোলন থেকে গ্রেপ্তার শ্রমিকদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের সংগঠন অ্যামেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন (এএএফএ)। এককভাবে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র।

গত ১৯ মার্চ এএএফএর প্রেসিডেন্ট ও সিইও স্টেফান ল্যামার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ বিষয়ে একটি চিঠি পাঠান, যার একটি কপি বেনারের হাতে এসেছে।

ওই চিঠিতে বলা হয়, “আমরা মজুরির আন্দোলনে যেসব শ্রমিকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের ছেড়ে দেওয়া, তাদের বিরুদ্ধে হওয়া সব ফৌজদারি মামলা তুলে নেওয়া এবং আরও হাজার হাজার শ্রমিককে গ্রেপ্তারের ভয় না দেখানো ও ভবিষ্যতের হয়রানি না করার আহ্বান জানাই।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।