শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যা: ৫ বছরেও তদন্তে অগ্রগতি নেই
2017.04.05
ঢাকা
পাঁচ বছর পার হলেও গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার আন্দোলনের নেতা আমিনুল ইসলামকে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার তদন্তের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। এই ঘটনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থাকলেও সরকার তা খতিয়ে দেখেনি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে। ‘বাংলাদেশ: ফাইভ ইয়ার্স অন, নো জাস্টিস ফর আমিনুল ইসলাম’ শীর্ষক বিবৃতিমূলক এক প্রতিবেদনে আমিনুল হত্যার জবাবদিহির জন্য বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিতে আন্তর্জাতিক দাতা ও বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাকের বিভিন্ন ব্রান্ডের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
২০১২ সালের ৪ এপ্রিল নিখোঁজ হন আমিনুল ইসলাম। দু’দিন পর সর্বশেষ তাকে যেখানে দেখা গিয়েছিল, সেখান থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। এ সময় মৃতদেহে নির্যাতনের চিহ্ন ঘটনাটির সঙ্গে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “ঘটনাটির যে পারিপার্শ্বিক তথ্য প্রমাণ ছিল তাতে এর সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের সংশ্লিষ্ট থাকার সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ ছিল। তাই যারা ঘটনাটি তদন্ত করছে তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ থাকায় এ তদন্তে ফলপ্রসূ কোনো কিছু বেরিয়ে আসবে না।”
তাঁর মতে, এর জন্য প্রয়োজন বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষ তদন্ত। সে ক্ষেত্রে কিছু হয়তো জানা যেতে পারে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে সংগঠনটির এশিয়াবিষয়ক উপপরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, ৫ বছর পরেও আমিনুলের কী ঘটেছিল এবং কারা তাকে হত্যা করেছিল তা তার পরিবার বা জনগণ কেউই জানতে পারেননি। এতে নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যদের জড়িত থাকার গুরুতর অভিযোগ ছিল।
“কিন্তু তা তদন্ত না করে সরকার বলছে, ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে আমিনুলের মৃত্যু হয়েছে। এর মাধ্যমে মূলত পুরো ঘটনা থেকে তারা তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি ধুয়ে মুছে নিয়েছে,” বলেন রবার্টসন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩৯ বছর বয়স্ক আমিনুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি (বিসিডব্লিউএস) নামের একটি ট্রেড ইউনিয়নের সংগঠক। তার সংগঠন গার্মেন্টস ও সমুদ্রজাত খাদ্য প্রস্তুতকারী কারখানার শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে কাজ করে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, পুলিশের তোলা আমিনুল ইসলামের মৃতদেহের ছবিতে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। তার ডান পায়ে হাঁটুর নিচে ক্ষত ছিল, পায়ের আঙুল থেঁতলে গিয়েছিল। দুই হাঁটুতেই ছিল জমাটবাঁধা রক্ত। শরীরের বিভিন্ন অংশেও ছিল আঘাতের কারণে থেঁতলে যাওয়ার চিহ্ন।
সে সময় ঘাটাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমিনুলকে হত্যা করা হয়েছে। তার পায়ে গর্তসহ মারাত্মক ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। সূচালো কোনো কিছু দিয়ে এটা করা হয়েছে। পায়ের সবগুলো আঙুলও ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়মুক্তির দীর্ঘ ইতিহাস আছে বাংলাদেশে। তাই আমিনুল ইসলাম হত্যার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে দীর্ঘদিন ধরে আহ্বান জানিয়ে আসছে।
এ অবস্থায় ২০১৩ সালের নভেম্বরে এ হত্যার জন্য গার্মেন্টসের সাবেক শ্রমিক মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে সিআইডি। আমিনুল ইসলাম নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে মোস্তাফিজুর রহমানও কোথায় তা অজানা। তবে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ দাবি করে সে ভারতের কোথাও পালিয়ে আছে।
২০১৪ সালের ৮ জানুয়ারি সিআইডির সহকারী পুলিশ কমিশনার ফজলুল কবির সাবেক গার্মেন্টস কর্মী মুস্তাফিজুরকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। জানতে চাইলে বেনারকে ফজলুল কবির বলেন, তদন্তে ঘটনার সঙ্গে মুস্তাফিজুরের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তাই তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
“বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না,” জানান ওই কর্মকর্তা। নিখোঁজ মুস্তাফিজুরের কোনো সন্ধান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির (বিসিডব্লিউএস) নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বেনারকে বলেন, আমিনুল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার ভাই রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন। সিআইডির দেওয়া অভিযোগপত্রের পর এর বিরুদ্ধে তিনি নারাজি পিটিশন দায়ের করেছিলেন। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তার ওপর কোনো শুনানি হয়নি।
কল্পনা বলেন, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) যখন তদন্ত করছিল, তখন ঘটনাটির সঙ্গে বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার লোকজন জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কেও তখন বাদিপক্ষকে জানানো হতো। কিন্তু তদন্ত যখন থেকে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে চলে যায়, তখন থেকেই তারা আর কোনো কিছু জানতে পারেননি।
কল্পনা মনে করেন, ঘটনার সঙ্গে নিরাপত্তা সংস্থার লোকজন জড়িত। তাদের বাঁচাতে গিয়েই শুধু একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে ফিল রবার্টসন বলেছেন, যতক্ষণ আমিনুল ইসলামের ঘটনায় সব অপরাধীকে খুঁজে বিচারের আওতায় আনা না হবে ততক্ষণ বাংলাদেশের ব্যর্থতার বিষয়টি আন্তর্জাতিক নজরদারিতে রাখা উচিত। গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার অব্যাহতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।