করোনা মহামারির মধ্যেও বেড়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানি

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.07.21
ঢাকা
করোনা মহামারির মধ্যেও বেড়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানি করোনা মহামারীর মধ্যেও কর্মরত এক গার্মেন্টস কর্মী। ঢাকা। ৭ মে ২০২০।
বেনার নিউজ

করোনা মহামারির মধ্যেও জুন ৩০ তারিখে সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত থেকে আয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩১ বিলিয়ন ডলার যা গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার বেশি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সাম্প্রতিক বিবরণী থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা  মহামারির মধ্যে বাংলাদেশে প্রস্তুত কমদামী পোশাকের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে তৈরি পোশাক খাতে আয় বেড়েছে।

ফলে সার্বিকভাবে দেশের রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। কারণ বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা প্রায় ৮৪ ভাগ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে।

এছাড়াও, পশ্চিমা দেশগুলোতে অর্থনীতি খুলে দেয়া, ভারতের করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মারাত্নক অবনতি এবং মিয়ানমারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সঙ্কট বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে সহয়তা করেছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

তবে ২৩ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া লকডাউনের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪২ বিলিয়ন ডলার। এবং সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছে তৈরি পোশাক খাত থেকে।

তৈরি পোশাকের নীট খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ১৩ দশমিক নয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ওভেন গার্মেন্টস থেকে আয় হয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। অর্থাৎ নীট ও ওভেন মিলিয়ে তৈরি পোশকের সম্মিলিখাত থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয় হয়েছে ২৭ দশমিক নয় বিলিয়ন ডলার।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বলছে, ২০২০-২১ (০১ জুলাই ২০২০-৩০ জুন ২০২১) অর্থবছরে নীট খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ১৬ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার এবং ওভেন গার্মেন্টস থেকে আয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দুই খাত থেকেই রপ্তানি আয় বেড়েছে।

নীট এবং ওভেন থেকে এবছর জুন মাসে শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩১ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় ছিল ৫২ দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।

তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান বেনারকে বলেন, করোনার কারণে গতবছর আমাদের কারখানা এপ্রিল-মে মাসে বন্ধ ছিল। সেকারণে আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।”

তিনি বলেন, “তবে কারখানা খোলার পর আমরা যা করেছি, ইউরোপ-আমেরিকাসহ ক্রেতাদেরকে আমরা কম দামে পণ্য সরবরাহ করেছি। আমরা আমাদের ক্রেতাদের চলে যেতে দিইনি।”

ফারুক হাসান বলেন, “এবছর যেহেতু ইউরোপ-আমেরিকা ওপেন হয়েছে সেহেতু চাহিদা বেড়েছে। আমাদের কাছে ক্রয়াদেশ আছে। আশা করি আমরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবো।”

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “গত অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হলো, লকডাউনে ইউরোপ-আমেরিকায় মানুষ ক্যাজুয়াল ড্রেস বেশি ক্রয় করেছে। আমরা ক্যাজুয়াল ড্রেস সরবরাহ করেছি।”

ফারুক হাসান বলেন, “২৩ তারিখ থেকে যে লকডাউন দেয়া হচ্ছে এই লকডাউনে আমরা ক্ষতির মূখে পড়তে পারি। এর কারণ হলো, পশ্চিমা দেশগুলোতে অক্টোবর, নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে যেসকল পোশাকের চাহিদা আছে সেগুলো ১৫ আগস্টের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে। আমরা মারাত্নক চাপের মধ্যে আছি। সেকারণে আমরা কারখানাগুলো খোলা রাখার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি।”

বেসরকারি অর্থনীতি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “আশার খবর যে ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে তৈরি পোশাকখাতসহ সার্বিকভাবে দেশের রপ্তানি আয় বেড়েছে।”

তিনি বলেন, “এর কারণ হলো, আমাদের তৈরি পোশাকের মূল বাজার ইউরোপ-আমেরিকায় চাহিদা তৈরি হয়েছে। সেখানে কোভিড পরিস্থিতি ভালো। সুতরাং, আমাদের ব্যবসায়ীরা কার্যাদেশ পাচ্ছেন। একারণে রপ্তানি বেড়েছে।”

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর বলেন, “আরেকটি কারণ হলো, ভারতে যখন করোনা পরিস্থিতি ভয়ানক তখন বাংলাদেশে পরিস্থিতি ভালো ছিল। তাই ভারতের বেশ কিছু কার্যাদেশ বাংলাদেশে আসে। একইসাথে আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমারে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে সেখানকার অনেক কার্যাদেশ বাংলাদেশে এসেছে।”

তিনি বলেন, “তবে আসন্ন লকডাউনে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সেটি ঠিক। কিন্তু তাঁদের কার্যাদেশ বাতিল হয়ে যাবে সেটি বলা বোধ হয় ঠিক নয়। কারণ এতো বড় বড় ক্রেতারা রাতারাতি চলে যাবেন না।”

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর বলেন, “আমাদের কোভিড পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। সেকারণে কারখানার মানুষদের রক্ষার জন্য সরকার লকডাউন ঘোষণা করেছে। এই মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমাদের কাছ থেকে ক্রেতারা পণ্য কিনবেন না।”

তিনি বলেন, “সেকারণে বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে। তবে কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি হলে আমাদের কারখানাগুলো বাড়তি দুই-তিন শিফট চালু করে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।”

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর বলেন, তবে লকডাউন শেষ হলে পণ্য দ্রুত পরিবহনের জন্য সরকারের সহয়তা প্রয়োজন হলে সেই সহয়তা দেয়া উচিত।

তাঁর মতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ তৈরি পোশাক খাতকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে সহয়তা করেছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ. মনসুর বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ মূলত কম ও মধ্যম মূল্যের পোশাক তৈরি করে থাকে। লকডাউনের মধ্যে দামী পোশাকের চাহিদা একেবারেই ছিল না। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এই সুবিধাটি পেয়েছেন।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী দামী পোশাক যেমন স্যুট তৈরি করতে গিয়ে করোনা মহামারির কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছেন। কারণ ইউরোপ-আমেরিকায় মানুষ আর দামী পোশাক ক্রয় করেননি।”

পরিচালক আহসান বলেন, “আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে সেটি সত্য। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। বলতে গেলে আমরা এখনও রিকভারি ফেজে আছি। আমাদের রপ্তানি আয়কে করোনাভাইরাস মহামারির আগের পর্যায়ে নিয়ে তার পর বৃদ্ধি করতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।