কঠোর লকডাউনে পোশাক খাতের ক্ষতি হতে পারে: বিজিএমইএ
2021.07.23
ঢাকা
শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হওয়া ১৪ দিনের কঠোর লকডাউনে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতকে আবারও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে মনে করছেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র নেতারা।
ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় যখন পোশাকের ক্রয় আদেশ বাড়ছে, তখনই দেশে গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ করায় ক্রেতারা ভিয়েতনামসহ অন্য দেশে চলে যেতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদউল্লাহ আজিম বেনারকে বলেন, “জীবন বাঁচানোর তাগিদে লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার, একে স্বাগত জানাই। তবে জীবন ও জীবিকা দুটোই চলতে হবে।”
“করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকায় সব খুলে গেছে। এখন তাদের পোশাকের চাহিদা অনেক। যখন প্রচুর অর্ডার তখন আমরা এখানে লকডাউনে পড়লাম। কিন্তু ক্রেতারা তো আর বসে থাকবে না। তারা অর্ডার বাতিল করে ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশে চলে যেতে পারে,” বলেন তিনি।
“মিয়ানমারে সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসা এবং ভারতের লক ডাউনের কারণে অনেক অর্ডার আমাদের দেশে চলে এসেছিল। সেগুলো রপ্তানি করতে পারলে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি আরো শক্তিশালী হতো,” বলছিলেন শহীদুল্লাহ আজিম।
তিনি বলেন, “শ্রমিকেরা যখন কারখানায় থাকে তখন কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের কাজ করানো হয়। বরং কারখানা বন্ধ থাকলে তারা বাইরে ঘোরাফেরা করবে, গ্রামে যাবে। তাতে সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
ক্ল্যাসিক ফ্যাশন কনসেপ্টের এই কর্ণধার বলেন, “পোশাক খাতে করোনার সংক্রমনের হার সবচেয়ে কম; মাত্র শূন্য দশমিক তিন শতাংশ। সরকারকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তারপরেও সরকার হয়তো পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কায় সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে।”
শহীদুল আজিম বলেন, “কোভিড-১৯ মহামারীর পূর্বে আমাদের রপ্তানি আয় ছিল প্রায় ৩৪ মিলিয়ন ডলার। মহামারীর কারণে সেটা কমে এসেছে ২৬ মিলিয়ন ডলারে কমে আসে। এরপরে সদ্য শেষ হওয়া অর্থ বছরে ৩.১ মিলিয়ন ডলারে রপ্তানি হয়েছে। চলতি অর্থ বছরে আরো ৪-৫ মিলিয়ন ডলার বেশি আয় করতে পারতাম। তবে এই লক ডাউন অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।”
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকায় বিশেষজ্ঞদের সুপারিশে গত ১ জুলাই থেকে দুই সপ্তাহ লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু শেষ দিকে এসে জীবিকার তাড়নায় অনেকেই রাস্তায় বের হতে শুরু করেন।
ঈদ উপলক্ষে গত ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত সব ধরনের বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। তবে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে আবারও বিধিনিষেধ কার্যকর হবে বলেও তখন জানানো হয়।
এর আগে গত বছর সাধারণ ছুটিতে পোশাক কারখানা বন্ধ করা হয়। তখন হাজার হাজার গার্মেন্টসকর্মী গ্রামে চলে যান। আবার বেতন দেওয়ার খবরে ট্রাকে গাদাগাদি করে ও পায়ে হেঁটে কর্মস্থলে ফিরে আসেন। কিন্তু ঢাকায় আসার পরে তারা জানতে পারেন, কারখানা বন্ধ।
সাধারণ ছুটির একমাস ছাড়া দেশে আরো কয়েক দফা লকডাউন ঘোষণা করা হলেও পোশাক কারখানা বন্ধ করা হয়নি। তবে এবার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে পোশাক কারখানাও বন্ধ করা হয়েছে।
তবে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক কে এম মিন্টু বেনারকে বলেন, “আগাম লকডাউনের ঘোষণা দেওয়ায় ঈদের আগে পোশাক কারখানাগুলো ছুটির দিনগুলোতে বাড়তি কাজ করিয়ে নিয়েছে। এরপর আগামী ২৮-২৯ জুলাই পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে।”
“সে হিসেবে লডডাউনের কারণে মাত্র এক সপ্তাহ কারখানা বন্ধ থাকবে। এতে খুব বেশি লোকসান হবে বলে মনে হয় না। কারণ কারখানা খুললেই আবার বাড়তি কাজ করিয়ে নেওয়া সম্ভব,” বলেন তিনি।
“বিশেষজ্ঞদের কথা মেনে সরকারের গার্মেন্টস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কারণ, জীবন সবার আগে,” বলেন এই শ্রমিক নেতা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “পোশাক কারখানাগুলোতে করোনা পরীক্ষার হার কম বলেই সেখানে রোগী শনাক্ত হচ্ছে কম। অনেকে করোনার লক্ষণ দেখা দিলেও চাকরি হারানোর ভয়ে টেস্ট করান না। আবার অনেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চিকিৎসা করান।”
কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও গার্মেন্টস খোলা রাখার দাবি জানিয়ে গত ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি দেন পোশাক কারখানার মালিকেরা।
চিঠিতে বলা হয়, “এখন কাজের প্রচুর চাপ থাকায় ঈদে লম্বা ছুটির সুযোগ নেই। সরকার ঘোষিত ১৪ দিন লকডাউন ও ঈদের ছুটিসহ প্রায় ১৯-২০ দিন বন্ধ পেয়ে শ্রমিকরা ছুটে যাবে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায়, এর মধ্যে কিছু এলাকা করোনার রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত। এসব শ্রমিক পরে কর্মস্থলে ফিরে আসলে কোভিড-১৯ সংক্রমণের মাত্রা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
চিঠিতে বলা হয়, “২০ দিন বন্ধ রাখার পর কারখানা খোলার সঙ্গে সঙ্গে জুলাই মাসের বেতন পরিশোধের বিষয়টি সামনে চলে আসবে। তাই ঈদের পরে খুলে দিলে এই খাতটি বহুমুখী বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাবে।”
যদিও দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বর্তমান পরিস্থিতিতে পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বেনারকে বলেন, “জনস্বার্থ বিবেচনায় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সব কিছু বন্ধ রাখাই সর্বোত্তম পন্থা। পোশাক কারখানাও এর বাইরে নয়। তাই সরকারের এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক।”
“সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশ ও দৈনিক মৃত্য ৫০ জনের কমে নামলে তখন সরকার পরিস্থিতি বিবেচনা করে কিছু কিছু সেক্টর খুলে দিতে পারে,” মনে করেন তিনি।
আরো ১৬৬ জনের মৃত্যু
দেশে কঠোর লক ডাউনের প্রথম দিনে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬৬ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ছাড়া একই সময়ে সারা দেশে ২০ হাজারের বেশি নমূনা পরীক্ষা করে ৬ হাজার ৩৬৪ জনের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে।
শুক্রবারের বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, নতুন আক্রান্তদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৪৬ হাজার ৫৬৪ জনে। আর করোনায় এ পর্যন্ত মোট ১৮ হাজার ৮৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
কঠোর লক ডাউনের প্রথম দিন শুক্রবার সকাল থেকে রাজধানীর রাস্তাগুলো ছিল ফাঁকা। বিভিন্ন স্থানে র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর টহল দেখা যায়। তবে ঈদের ছুটি শেষে অনেকে রাতের লঞ্চে বা বাসে করে রাজধানীতে ফিরে আসেন। কিন্তু ভোরে যানবাহন না পেয়ে বিপাকে পড়েন, শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত অনেককে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়েছে।
এদিকে লক ডাউনের মধ্যে অপ্রয়োজনে বের হওয়ায় শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৪০৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০৩ জনকে মোট এক লাখ ২৭ হাজার ২৭০ টাকা জরিমানা করার কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।