তাপপ্রবাহে পুড়ছে অর্ধেকের বেশি এলাকা
2024.04.05
ঢাকা
এপ্রিলের শুরুতেই ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর তাপমাত্রা, যা দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকা। আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রায় প্রতিদিনই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করছে।
তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ পর্যন্ত মৃদু ও ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বিবেচনা করা হয়।
আবহাওয়াবিদদের মতে, এই তাপপ্রবাহ আগামী সোমবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তবে এপ্রিলেই আরও একটি তাপপ্রবাহ আসতে পারে এবং সে সময় পারদ ৪১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে যে তাপপ্রবাহ চলছে, সেটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এমন তাপপ্রবাহ শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, সারা বিশ্বেই চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া বিরাজ করছে।
চলমান তাপপ্রবাহে রাজধানী ঢাকা ও তিন বিভাগের জেলাগুলোতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ।
বিভিন্ন জেলার স্বাস্থ্য অফিস থেকে অপ্রয়োজনে বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। রমজান মাসে তাপপ্রবাহ শুরু হওয়ায় মুসলমানরা রোজা রাখতে এবং চলাফেরা করতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে এপ্রিল হলো সবচেয়ে গরম মাস। এ বছর মার্চ মাসে তাপমাত্রা তুলনামূলক অনেক কম ছিল।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। স্থান ভেদে তাপমাত্রা বর্তমানে ৩৬ থেকে প্রায় ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে গেছে। আগামী দুই দিন এই তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে এবং তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকায় তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে।”
বজলুর রশীদ বলেন, “সোমবারের পরে তাপমাত্রা একটু কমবে। কোথাও কোথাও হালকা বৃষ্টি হবে। এরপর পুনরায় তাপপ্রবাহ শুরু হবে। সে সময় তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যেতে পারে।”
তাপপ্রবাহের প্রভাব গৃহস্থালি কাজ থেকে শুরু করে উৎপাদনশীল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পড়তে শুরু করেছে। কৃষি উৎপাদনশীলতা নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
ক্ষতিগ্রস্ত উপার্জন, ব্যবসা
সাভারের একটি ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পের স্বত্বাধিকারী রুহুল হোসেন শুক্রবার বেনারকে বলেন, “গরম বেড়ে যাওয়ার পর বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। ফলে কিছুক্ষণ পর পর বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। আমাদের কারখানার কারিগররা বসে থাকছে।”
তিনি বলেন, “রোজার দিন এমনিতেই কর্মঘণ্টা কম। এর মধ্যে যদি কিছুক্ষণ পর পর বিদ্যুৎ চলে যায়, তাহলে কীভাবে আমরা কারখানা চালাব, ব্যবসা চালাব?”
নওগাঁর সদর উপজেলার বাসিন্দা মোসলেমা বেগম বেনারকে বলেন, “আমাদের এখানে বাতাস নেই, ভ্যাপসা গরম। সারাক্ষণ ঘামছি, রোজা থাকা কঠিন হয়ে গেছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। মানুষের জীবন কঠিন হয়ে পড়েছে।”
ঢাকার পল্লবী এলাকায় রিকশা চালান মো. এমদাদ। তিনি বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “গত কয়েক দিন ধরে কাঠফাটা রোদ। মেঘ নেই, বৃষ্টি নেই। গরমে গাড়ি চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। দুই ট্রিপ মারার পর শরীর ঘেমে যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আবার গরমে রাস্তায় মানুষ কমে গেছে। ঈদের আগে দিনে কমপক্ষে হাজার টাকা না কামালে চলবে কীভাবে? কিন্তু গতকাল ৬০০ টাকা আয় করেছি। আজকেও খুব ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
স্বাস্থ্য সতর্কতা
রাজশাহীর সিভিল সার্জন আবু সাইদ মোহাম্মদ ফারুক শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আবহাওয়া অফিস তাপপ্রবাহের কথা জানানোর পর পরই আমার অফিস থেকে স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করা হয়েছে। কৃষকরা যেন মাঠে কাজ করার সময় মাথায় মাথাল ব্যবহার করেন।”
তিনি বলেন, এই সময়ে শিশুরা যেন বাইরে কম যায় সে বিষয়ে নজর দিতে বলা হয়েছে। মানুষ যেন বেশি বেশি পানি পান করে, সে বিষয়ে বারবার বলা হচ্ছে।
“অত্যধিক গরমে ঘেমে অনেকে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন, পানি স্বল্পতা হতে পারে, ডায়রিয়াসহ প্রচণ্ড বমি হতে পারে,” যোগ করেন তিনি।
সাইদ বলেন, “রাজশাহীতে প্রতিবছর তাপপ্রবাহ দেখা দিচ্ছে। এ সময় মানুষের বিভিন্ন রোগবালাই হয়। সে কারণে জেলার সব হাসপাতালে জরুরি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।”
চলমান তাপপ্রবাহে ফসলের ক্ষতির আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক ড. হামিদুর রহমান।
তিনি বেনারকে বলেন, “এখন মাঠে ধান রয়েছে, ধান পুষ্ট হবে। এই সময়ে অত্যধিক তাপ থাকলে ধানের দানা চিটা হয়ে যেতে পারে।”
হামিদুর রহমান বলেন, “বোরো ধান আমাদের দানাদার ফসল। এই ধান চিটা হয়ে গেলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। তাছাড়া এখন গাছে আমের গুটি রয়েছে। গরম নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেড়ে গেলে আমের গুটি ঝরে যাবে, উৎপাদন কম হবে। এতে দেশের সার্বিক পুষ্টি পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সাবেক উপপরিচালক মিজান আর. খান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, এপ্রিল মাস সবচেয়ে গরম মাস সেটি ঠিক। গত বছর এক নাগাড়ে তিন সপ্তাহের মতো তাপপ্রবাহ চলেছে। এগুলো আবহাওয়ার স্বাভাবিক আচরণ নয়।
তিনি বলেন, “বর্তমানে যে তাপপ্রবাহ চলছে, এটি শুধু বাংলাদেশ অথবা দক্ষিণ এশিয়ায় নয়। সারা বিশ্বে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে তাপদাহ চলছে। যেমন গত বছরও আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় তাপপ্রবাহ, বন্যাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা গেছে।”
মিজান বলেন, “বর্তমান বছরগুলোতে আবহাওয়ার যে অস্বাভাবিক আচরণ (ইটারিক বিহ্যাভিয়ার) সেগুলোর ব্যাপারে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা একমত যে, এগুলো মানুষের জীবনযাত্রার ফলে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেই ঘটছে। আইপিসিসি ষষ্ঠ প্রতিবেদনে এই ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও চরম তাপমাত্রার প্রভাব বেশি। এর কারণ হলো, শহরাঞ্চলের ভূমির ব্যবহারের ধরন। গ্রামাঞ্চলে গাছ বেশি, শহরাঞ্চলে দালান বেশি। শহরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার বেশি। সব মিলিয়ে শহরাঞ্চলে তাপপ্রবাহের মাত্রা অনেক বেশি হবে এবং বাংলাদেশে ঢাকায় তাপপ্রবাহের প্রভাব অনেক বেশি থাকবে।”