পাঁচ দিনের মাথায় ফের আগুনে পুড়ল সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি
2016.11.04
ঢাকা থেকে
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে পাঁচ দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের পাঁচটি ঘরে ফের আগুন লাগিয়েছে দুর্বৃত্তরা। নিরাপত্তা জোরদার করার পরও কীভাবে এমন ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
স্থানীয় হিন্দুরা বলেছেন, গত রোববারের পর শুক্রবার ভোরে দ্বিতীয় দফা এই হামলার ঘটনায় তাঁরা চরম আতঙ্কে আছেন।
জানতে চাইলে নাসিরনগর উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি আদেশ চন্দ্র দেব বেনারকে বলেন, “একের পর এক এমন হামলার ঘটনার পর হিন্দুরা চরম আতঙ্কে থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। যারা এ কাজ করছে তাদের লক্ষ্যও আতঙ্ক সৃষ্টি করা, বিশেষ পরিস্থিতির সুবিধা নেওয়া।”
গত বৃহস্পতিবার থানা এলাকায় ৮০ জন পুলিশ মোতায়েন ছিল। শুক্রবার আরও ২০০ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তারপরও এলাকার মানুষ স্বস্তি পাচ্ছে না।
নাসিরনগরের ঘনবসতিপূর্ণ সরকারপাড়াতেই বেশ কয়েকটি ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে কবিরাজ বিশ্বদেব চক্রবর্তীর কাঠের ঘর দুষ্কৃতকারীরা পুড়িয়ে দেয়। ওই পাড়ার ফুল কিশোর সরকারের গোয়ালঘর আগুনে পুড়ে গেছে। তাঁর প্রতিবেশী মৃণাল কান্তি সরকারের রান্নাঘর ও গোয়ালঘরও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
“নিরপত্তা জোরদার করার পর আগুন লাগানোর এ ঘটনাটি রহস্যজনক। যারা হামলা করেছে, নিশ্চয়ই কোনো দলের সমর্থক। অপরাধী যেই হোক ছাড় পাবে না,” বেনারকে জানান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান।
তাঁর মতে, দেশকে যারা পিছিয়ে দিতে চায়, তারা এই হামলা করতে পারে।
জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান গতকাল ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনা ষড়যন্ত্রমূলক। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খোঁজা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে দল বেঁধে ১৫টি মন্দির এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক ঘর ভাঙচুর করা হয়। ২৮ অক্টোবর নাসিরনগরে জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ফেইস বুক পাতায় একটি পোস্ট নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত ।
ফেইস বুকে রসরাজ ‘ইসলাম অবমাননা করে’ পোস্ট দিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠার পর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। তারপরও সেখানে সমাবেশ ডাকে ধর্মভিত্তিক দুটি সংগঠন। সমাবেশ শেষ হওয়ার পর পর হিন্দুদের বাড়ি ও মন্দিরে হামলা হয়।
তোপের মুখে দুই মন্ত্রী
পুলিশের পক্ষে সাফাই গেয়ে গত বৃহস্পতিবার সমালোচনার মুখে পড়েন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। আর সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ তুলে সমালোচিত হচ্ছেন আরেক মন্ত্রী ও স্থানীয় সাংসদ ছায়েদুল হক।
গতকাল ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে অনুষ্ঠিত সভা–সমাবেশে ছায়েদুল হকের পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, হামলার চারদিন পর তিনি বৃহস্পতিবার এলাকায় যান। সেখানে এক সমাবেশে তিনি সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দেন।
তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মন্ত্রী। ফেসবুকের সমালোচনা এবং বিভিন্ন সমাবেশ থেকে পদত্যাগ দাবি করা প্রসঙ্গে ছায়েদুল হক বেনারকে বলেন, “এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। যারা এগুলো ছড়াচ্ছে তাদের নিন্দা জানানোর ভাষা তাঁর জানা নেই।”
গতকাল বিভিন্ন সংগঠন তাঁর পদত্যাগ দাবি করা প্রসঙ্গে ছায়েদুল হক বলেন, “আমি যদি ডিসি-এসপিদের নিয়ে ট্যাকল না দিতাম অবস্থা আরো খারাপ হতে পারত।”
অন্যদিকে হামলা মোকাবিলায় পুলিশ যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মত দেওয়ার পর সমালোচনার মুখে পড়েছেন স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
গতকাল ঢাকায় এক সমাবেশে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, সেখানে পুলিশের কোনো গাফিলতি নেই। তদন্ত ছাড়া তিনি এ ধরনের কথা কীভাবে বলতে পারেন?”
বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি
হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার ঘটনায় গতকাল দেশজুড়ে ক্ষোভ–বিক্ষোভ হয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে জেলা ও থানা শহরে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়।
এসব কর্মসূচি থেকে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে ঘটনার তদন্ত ও বিচার দাবি করা হয়।
“আমরা মনে করি বিচার বিভাগীয় তদন্ত না হলে পুলিশ ও প্রশাসনের গাফিলতির প্রমাণ মিলবে না, দুর্বৃত্তদের খুঁজে পাওয়া যাবে না,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।
বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিনের নেতৃত্বে আট সদস্যের প্রতিনিধিদল শুক্রবার নাসিরনগরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে। হাফিজউদ্দিন এ ঘটনার তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন।
বিক্ষোভ–সমাবেশ চলছেই
হামলার প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জাতীয় প্রেসক্লাব এবং শাহবাগে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয়।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ‘রুখে দাঁড়াও সাম্প্রদায়িক হায়েনা’ শীর্ষক সমাবেশের আয়োজন করে শহীদ মিনারের সামনে।
সমাবেশে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হামলা কোনো একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের ওপর হামলা নয়, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সংবিধানের ওপর হামলা।
ঢাকায় লেখক, শিল্পী ও সাংষ্কৃতিক কর্মীদের মশাল মিছিল। নিউজরুম ফটো।
হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে শাহবাগে সমাবেশ ও মশাল মিছিল করেছে লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। সমাবেশে নারীনেত্রী খুশী কবির বলেন, সরকারের দায়িত্ব দেশের সকল মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু নাসিরনগরে সরকার এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
এ ছাড়া হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ এক ডজনেরও বেশি সংগঠন শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।
আওয়ামী লীগের তিন নেতাকে বহিষ্কার
গত রোববার ধর্মভিত্তিক দুটি দলের সমাবেশে লোকজন নিয়ে যোগ দেওয়ার অভিযোগে সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের সহসম্পাদক আবুল হাসেম, চাপড়তলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরুজ আলী এবং হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক মিয়াকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
ঘটনা তদন্তে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হেলাল উদ্দিনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটিও করা হয়েছে।
হামলাকারীদের মোকাবিলা করা হবে
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংখ্যালঘুদের প্রার্থনালয়, বাড়ি এবং মন্দিরে হামলাকারীদের কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে। গতকাল শুক্রবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের এসব কথা বলেন।
ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সম্প্রদায়কে উদ্দেশে তিনি বলেছেন, “আপনারা নিজেদের মাইনরিটি ভাববেন না। মাথা উঁচু করে বাঁচবেন, মাথা নিচু করে নয়।”
সাম্প্রদায়িক উসকানির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সরকার এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছে এবং কঠোরভাবে মোকাবিলা করবে।”