অপব্যবহারের সুযোগ রেখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদন
2018.01.29
ঢাকা
তথ্য প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি) বিতর্কিত ৫৭ ধারাসহ বেশ কয়েকটি ধারা বিলুপ্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা। তবে বিতর্কিত বিলুপ্ত ধারার বিষয়গুলোই নতুন আঙ্গিকে সাজানো হওয়ায় নতুন আইনেও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা।
এমনকি স্বাধীন সাংবাদিকতাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৮’ এর খসড়া এই অনুমোদন পায়।
নতুন আইন পাস হলে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্ত হবে বলে সোমবার সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিলুপ্ত ধারাগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবও। কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি কমানোর পাশাপাশি অপরাধের গুরুত্ব ও দণ্ডের মাত্রার ভিত্তিতে জামিনযোগ্য ও জামিন অযোগ্য বেশ কিছু ধারা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে ৫৭ ধারা বাতিল হলেও এই ধারায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো চলবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
প্রস্তাবিত আইনটি বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে। সেখানে পাশ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর শেষে এটি আইন হিসেবে কার্যকর হবে।
নতুন আইন, নতুন অভিযোগ
২০০৬ সালের আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলছে। সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে হয়রানি শিকার হয়েছেন। এ কারণেই এ ধারাটি বাতিলের দাবি ওঠে। এই ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিটও করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
এ প্রসঙ্গে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “এটা নিশ্চিত ফাঁকিবাজী হলো। উচিত ছিল ৫৭ ধারাকে সমূলে উৎপাটন করা। কিন্তু তা হয়নি।”
নতুন আইনের ৩২ ধারার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করবে এই আইন।”
এ ধারা অনুযায়ী, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য উপাত্ত, যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর এ অপরাধের শাস্তি হিসেবে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার মতে, “অনেক সময় সাংবাদিকেরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে আনেন। নতুন আইন পাশ হলে কোনো কারণে এই তথ্য প্রচার বা প্রকাশের পর বিপক্ষের যদি সেটা পছন্দ না হয়, তাহলে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির মামলা হতে পারে।”
নতুন এই আইনের কোনো কোনো ধারা বিলুপ্ত ৫৭ ধারার চেয়ে ভয়ংকর বলে মন্তব্য করেছেন আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরামের সভাপতি আরাফাত সিদ্দিকী সোহাগ।
এ ক্ষেত্রে এ আইনের ২৯ ধারার উদাহরণ আনেন তিনি। যেখানে বলা হয়েছে, মানহানিকর কোনো তথ্য দেওয়ার অপরাধের শাস্তি হিসেবে তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
আরাফাত সিদ্দিকী বেনারকে বলেন, “এই ধারাটি ৫৭ ধারার চেয়েও খারাপ। এটা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় হাতকড়াও বলা যায়।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তার জায়গাটা খুব কম উল্লেখ করে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বলেন, তারা (সাধারণ মানুষ) খুব ভালনারেবল অবস্থায় থাকবে। এই আইন পাশের ফলে একই অপরাধে দুই রকম শাস্তির ব্যবস্থাও তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, “বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২৯৫-২৯৮ ধারাগুলোর মধ্যেই ধর্মীয় অবমাননার শাস্তি কী হবে তা নির্ধারণ করা আছে। এটা প্রচলিত একটা আইন। অথচ এই আইন থাকা সত্ত্বেও ডিজিটাল আইনে নতুন করে বিষয়টি সংযোজন করে নতুনভাবে শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর ফলে যখন যাকে খুশি শায়েস্তা করার জন্য এই আইনের অপব্যবহারের সুযোগটা থেকেই যাচ্ছে।”
উল্লেখ্য, নতুন আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী, ধর্মীয় বোধ ও অনুভূতিতে আঘাত করার অপরাধে ১০ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
আরও যা আছে নতুন আইনে
২০১৬ সালের ২২ আগস্ট মন্ত্রিসভার নীতিগত অনুমোদন পায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি। এ আইনের ১৭ থেকে ৩৮ ধারায় বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্তির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে বলে সোমবার জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
শফিউল আলম বলেন, “ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো ধরনের প্রোপাগান্ডা চালালে, নতুন আইন অনুযায়ী ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।”
কেউ যদি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে জনগণকে ভয়ভীতি দেখায় এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, তাহলে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধানের কথা বলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭ ধারায়।
২৫ ধারায় বলা হয়েছে, ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভয়ভীতি দেখানোর শাস্তি হিসেবে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানাসহ উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
নতুন আইনের ৩০ ধারা অনুযায়ী, কেউ না জানিয়ে কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংক-বীমায় ই-ট্রানজেকশন করলে পাঁচ বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে।
এ ছাড়া ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে অরাজকতা সৃষ্টির শাস্তি হিসেবে এ আইনের ৩১ ধারা অনুযায়ী সাত বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
নতুন আইন অনুসারে, কেউ বেআইনিভাবে কারও ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে তাঁকে সাত বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে।
বেআইনিভাবে অন্য সাইটে প্রবেশ করার পর যদি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হতে পারে। আবার কেউ বেআইনিভাবে কারও ডিভাইসে প্রবেশ করলে এক বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডর বিধান রাখা হয়েছে।
এ আইনে কারও ডিভাইসে প্রবেশে সহায়তা করার শাস্তি হিসেবে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।