ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলে যুক্ত হলো ব্রিটিশ আমলের আইন

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.09.17
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
190817_Digital_secuirity_law_1000.JPG বিদ্যমান আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে ঢাকায় ছাত্র ফেডারেশনের বিক্ষোভ। এই আইনটি সংশোধিত আকারে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নামে সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮।
বেনারনিউজ

সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের দায়ে প্রায় একশো বছরের পুরোনো অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশের পক্ষে মতামত দিয়েছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

স্থায়ী কমিটির সুপারিশকৃত বিলটি পাশ হলে তা সাংবাদিকতা, চিন্তার স্বাধীনতা ও দেশে গণতন্ত্র হুমকির মধ্যে পড়বে বলে বিবৃতি দিয়েছে সম্পাদক পরিষদ।

বেসরকারি সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে এই আইন পাশ করা ‘আত্মঘাতী’ হবে বলে মন্তব্য করেছে।

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইমরান আহমেদ সোমবার সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল-২০১৮ এর ওপর কমিটির সুপারিশ জাতীয় সংসদে পেশ করেন।

গত ৯ এপ্রিল এই আইনটি উত্থাপন করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার। বিলটিকে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য উত্থাপনের পর আইনটি ১০-সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।

মন্ত্রীর তোলা মূল আইনে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রয়োগের প্রস্তাবনা ছিল না।

১৯২৩ সালের এই আইনের আওতায়, যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের কোনো দলিল, তথ্য, নোট, পরিকল্পনা, পাসওয়ার্ড, কোনো স্কেচ, মডেল সংগ্রহ, রেকর্ড ও প্রচার করেন অথবা অন্য কোনো ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করেন যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের কোনো শত্রু প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে উপকৃত হয়, তবে তিনি গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন।

‘কিছু নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে’

স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইমরান আহমদ বেনারকে বলেন, “আমরা আমাদের সুপারিশে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রয়োগের কথা বলেছি। কারণ, আমাদের হাতে তো কিছু নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। কোনো স্বাধীনতাই নিরঙ্কুশ নয়। আমাদের সংবিধানেও নিয়ন্ত্রণের কথা বলা আছে।”

তিনি বলেন, আমরা সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সাথে সভা করে তাঁদের মতামত নিয়েছি। আমরা চেষ্টা করেছি তাঁদের মতামতগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে। কোনো মতামত গ্রহণ করা না করার অধিকার আমাদের।”

ইমরান আহমদ বলেন, “আমরা বিলটি পাশ করার সুপারিশ করেছি।”

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, আশা করা যায় এই অধিবেশনেই ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল পাশ হবে।

বিলের নতুন সংযোজিত ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত করেন বা করতে সহায়তা করেন, তবে তিনি অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ডে অথবা ২৫ লাখ টাকা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাংলাদেশের তথ্য অধিকার আইনসহ অনেক আইনের সাথে সংঘাতপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন মানবাধিকার আইনজীবী ব্যারিস্টার জোত্যির্ময় বড়ুয়া।

“বাংলাদেশ সরকারের স্বচ্ছতার জন্য তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়েছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের সরকারের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে বাধা সৃষ্টি করবে। সমাজের মুক্ত আবহকে সংকুচিত করবে। আর সাধারণ মানুষের মধ্যে আরো ভীতির সৃষ্টি করবে।”

এছাড়া, “মানহানির জন্য আমাদের খুব শক্ত আইন আছে। সুতরাং, ডিজিটাল মানহানির জন্য ডিজিটাল আইন কতটুকু প্রয়োজন তাও আমাদের ভেবে দেখা দরকার,” যোগ করেন জোত্যির্ময় বড়ুয়া।

সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি

রোববার এক জরুরি সভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ওপর সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদন আলোচনা করে হতাশা প্রকাশ করে সম্পাদক পরিষদ।

বিবৃতিতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সাংবাদিকদের ও সংবাদ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যেসব মতামত দেওয়া হয়েছিল সেগুলোকে সম্পূর্ণভাবে অবহেলা করা হয়েছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনে।

বিবৃতিতে বলা হয়, প্রস্তাবিত আইনের মোট আটটি ধারায় কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়নি বিধায় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদন ‘প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হচ্ছে’ সম্পাদক পরিষদ।

ওই ধারাগুলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতাকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলবে।

পাশাপাশি, ঔপনিবেশিক আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রয়োগের বিধানকে অগ্রহণযোগ্য বলে বর্ণনা করে সম্পাদক পরিষদ।

সম্পাদক পরিষদ বলে, “আমরা সম্মানিত আইনমন্ত্রী ও তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রীর সাথে সভা করি। ওই সভায় উভয় মন্ত্রী আমাদের উদ্বেগ ও সংশয়গুলোকে নিরসনে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। প্রতিবেদন প্রস্তুত করার আগে সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের সাথে পুনরায় সভা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল স্থায়ী কমিটি।”

সম্পাদক পরিষদের মতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু বিধান সংবিধানে প্রদত্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের মূলনীতির বিরোধী। তা ছাড়া, আইনটি চিন্তা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করবে।

স্থায়ী কমিটির সুপারিশকৃত আকারে ডিজিটাল আইনটি পাশ না করতে সংসদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ।

বিলের ৪৩ ধারায় পুলিশ অফিসারকে পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

বিলের ২৯ ধারায় কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিকস বিন্যাসে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা পাঁচ লাখ টাকা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “অংশীজনের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে ও বিতর্কিত অংশকে বাদ না দিয়ে বিলটির ওপর সুপারিশ চূড়ান্ত করা উদ্বেগজনক।” তিনি বলেন, প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলের আটটি ধারা সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করবে।

এই ধারাগুলোতে ইলেকট্রনিকস উপায়ে ও ওয়েব সাইটে কিছু প্রকাশ করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনা, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতির দায়ে বিচার করা যেতে পারে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই আইন পাশ করা দেশের জন্য ‘আত্মঘাতী’ হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।