এনআরসি আতঙ্ক: ভারত থেকে দুই শতাধিক মানুষের অনুপ্রবেশ

প্রাপ্তি রহমান
2019.11.22
ঢাকা
191122_Infiltration_India_1000.jpg ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তে বিজিবির হাতে আটক কয়েকজন অনুপ্রবেশকারী। ১৮ নভেম্বরের ২০১৯।
[নিউজরুম ফটো]

আসামের মতো গোটা ভারতে নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি শুরু হবে এমন খবরে ভীত হয়ে গত দু’সপ্তাহে দুই শ’রও বেশি নারী-পুরুষ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা ঝিনাইদহের ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) একযোগে টহল বৃদ্ধি করেছে।

বর্ডার গার্ড, বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ৫৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল কামরুল আহসান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বেনারকে বলেন, “মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে ২০৩ জন অনুপ্রবেশ করেছেন। আদালতে উপস্থাপনের পর তাঁদের কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ।”

“তাঁরা অনেক বছর আগে বাংলাদেশ থেকে ব্যাঙ্গালোর, মুম্বাই ও দিল্লিতে গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন,” বলেন কামরুল আহসান।

তিনি আরও বলেন, “তাঁদের কাছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট নেই, আবার ভারতীয় আধারকার্ডও নেই। আসামের আদলে সারা ভারতবর্ষে এনআরসি শুরু হবে এ খবরে ভীত হয়ে তাঁরা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন। তাঁদের কথার সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে।”

তবে এ ধরনের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সরকারকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বেনারনিউজকে বলেন, “ভারত থেকে যে অনুপ্রবেশ ঘটছে, সে সম্পর্কে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে সরকারকে ভারতের কাছে বিষয়টি তুলে ধরতে হবে, একই সঙ্গে নজরদারি বাড়াতে হবে।”

তিনি বলেন, “ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বাংলা ভাষাভাষীদের অবৈধ অভিবাসী বলাটা একটা চল ছিল একসময়। এখন তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় এই চল শক্ত একটা অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এটা যে অসত্য তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। এনআরসিতে বহু ভারতীয় নাগরিকের নাম বাদ পড়ে গেছে।”

অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কমিটি

এদিকে বৃহস্পতিবার স্থানীয় প্রশাসন অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন মহেশপুরের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুজন সরকার।

ওই দিন উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই কমিটিতে জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

“ইউপি সদস্যদের নেতৃত্বে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি অপরিচিত কাউকে দেখলে প্রশাসনকে খবর দেবে। ভারত থেকে কেউ যেন ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারে সবাই সতর্ক আছে,” সুজন সরকার বেনারনিউজকে বলেন।

উল্লেখ্য, যে ২০৩ জন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন তাঁদের মধ্যে ৭৫ জন নারী, ৬৪ জন পুরুষ এবং ৬৪টি শিশু রয়েছে। ভাগ্যান্বেষণে তাঁরা বিভিন্ন সময়ে ভারতে গিয়েছিলেন।

মহেশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাশেদুল আলম বলেছেন, এই নারী-পুরুষ দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করছেন।

“দেখুন, ওরা বলছে, তারা বছর কুড়ি আগে এদেশ ছেড়ে গেছে। বেশির ভাগই বলছে তারা পাশের জেলা খুলনা, বাগেরহাটের বাসিন্দা ছিল। তাদের পূর্বপুরুষ, আত্মীয়স্বজন ওখানে রয়েছে। এসব তথ্য মিলিয়ে দেখা হচ্ছে,” বেনারনিউজকে বলেন তিনি।

এনআরসি হোঁচট খেলো

ভারতবর্ষ জুড়ে ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অফ সিটিজেনস (এনআরসি) বা নাগরিকপঞ্জি নিয়ে ভীতির মধ্যেই আসামে এনআরসি আপাতত বাতিলের ইঙ্গিত দিয়েছে ভারত সরকার। শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার এ সম্পর্কিত খবর ছেপেছে।

আনন্দবাজার বলছে, “বৃহস্পতিবার রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানান, গোটা দেশের সঙ্গেই আসামে নতুন করে এনআরসি হবে। যার সূত্র ধরে আসামের অর্থমন্ত্রীও জানান, রাজ্যে হওয়া এনআরসি পুরোপুরি বাতিল করে সারা দেশের সঙ্গে আসামেও নতুন করে এনআরসি হোক।”

উল্লেখ্য, গত ছ’বছর ধরে আসামে প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা খরচ করে এনআরসি চূড়ান্ত করে সরকার। তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই সমালোচনা শুরু হয়, বাংলাভাষাভাষী মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

ভারতীয় দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫০ সালে দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের ঢল সামলাতে ‘আসাম থেকে বহিষ্কার আইন’ পাস হয়। ১৯৫১ সালে প্রথম জনগণনার ভিত্তিতে এনআরসি হয়। ১৯৫৭ সালে ফের অভিবাসী আইন বাতিল হয়।

এর মধ্যে ১৯৮৩ সালে আসামের নেলিতে ভয়াবহ গণহত্যায় তিন হাজারের বেশি নিহত হন। এদের সিংহভাগই ছিলেন বাংলাভাষাভাষী। ১৯৮৫ সালে সিদ্ধান্ত হয় যে, ২৫ মার্চ ১৯৭১ এর পর যাঁরা ঢুকেছেন তাঁদের ভারত থেকে বহিষ্কার করা হবে।

তবে ২০০৯ সালে আসাম পাবলিক ওয়ার্কস নামে একটি বেসরকারি সংস্থা ভোটার তালিকা থেকে বিদেশিদের নাম কেটে দেওয়ার আরজি নিয়ে আদালতে যায়। ২০১৩ সালে আদালত তা গ্রহণ করলে ২০১৫ সাল থেকে নাগরিকপঞ্জি হালনাগাদ শুরু হয়।

গত ৩১ আগস্ট ২০১৯ সালে এনআরসি চূড়ান্ত হলে তা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। মোট তিন কোটি ৩০ লাখ আবেদনকারীর মধ্যে প্রায় ১৯ লাখ মানুষের নাম বাদ পড়ে যায় তালিকা থেকে।

দেখা যায়, অনন্ত কুমার মালো নামে আসামের অভয়পুরী আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদের নাম প্রকৃত নাগরিকদের তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে। যদিও তালিকায় স্থান পায় তাঁর পরিবারেরই অন্যান্য সদস্যদের নাম। এতে পুরো ভারতবর্ষ জুড়েই সমালোচনা চলতে থাকে। বহু মানুষ আশ্রয়হীন হওয়ার আশঙ্কায় পড়েন।

এর মধ্যে গত অক্টোবরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এনআরসিতে বাদ পড়াদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে না বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেন।

তারপরও যে শঙ্কা কাটেনি, তারই প্রমাণ দুই শতাধিক ব্যক্তির অনুপ্রবেশ। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সংখ্যাটা আরও বেশি হবে।

কথা হচ্ছিল মহেশপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ময়জুদ্দিন হামিদের সঙ্গে।

“আমরা আশঙ্কা করি সংখ্যাটা বেশি। সবাই ধরা পড়ছেন না। গোপনে অনেকে প্রবেশ করে নানাদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছেন। এদিকের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেই তারা সুযোগটা নিয়েছেন,” ময়জুদ্দীন হামিদ বেনারনিউজকে বলেন।

তিনি আরও বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিটি করার কাজ চলছে। প্রতি পালায় কমিটির সদস্যরা পাহারা দেবেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।