চালু হলো কলকাতা-খুলনা ট্রেন ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’
2017.11.09
কলকাতা ও ঢাকা
দীর্ঘ ৫২ বছর বছর পরে খুলনা ও কলকাতার মধ্যে সরাসরি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের সূচনা হলো। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই ট্রেনের যাত্রার সূচনা করেন।
দুদেশের মধ্যে যোগাযোগকারী সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই ট্রেনটির নাম দেওয়া হয়েছে বন্ধন এক্সপ্রেস। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
এই ট্রেনের উদ্বোধন করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পূরণ হলো।” আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, “দুই দেশের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হলো। কানেকটিভিটিকে মজবুত করতেই এই ট্রেন চালু হলো।”
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মতে, “বন্ধন এক্সপ্রেস দুই দেশের বন্ধনকেই আরও শক্তিশালী করবে।”
গত এপ্রিলে ভারত সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি খুলনা-কলকাতা ট্রেনটির পরীক্ষামূলক যাত্রার সূচনা করেন।
বৃহস্পতিবার বন্ধন এক্সপ্রেস উদ্বোধন হলেও আগামী ১৬ নভেম্বর থেকে এটি নিয়মিতভাবে চলাচল করবে বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক।
তিনি বলেন, “সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ৪৫৬ আসনের এই ট্রেনের বার্থ ভাড়া দেড় হাজার টাকা, আসনের ভাড়া এক হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে আরামদায়ক হবে যাত্রীদের ভ্রমণ।”
বন্ধন এক্সপ্রেস চালু হওয়ায় খুলনা, যশোরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ এখন থেকে অল্প সময়ে এবং স্বল্প অর্থ ব্যয়ে কলকাতা যাওয়া-আসা করতে পারবেন বলে মনে করেন মন্ত্রী।
কলকাতার পূর্ব রেলওয়ের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র বেনারকে বলেন, “আপাতত সপ্তাহে একদিন এই ট্রেন চলবে। প্রতি বৃহস্পতিবার ট্রেনটি সকাল ৭-১০ মিনিটে কলকাতা স্টেশন ছেড়ে বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত পেরিয়ে যশোর হয়ে খুলনায় পৌঁছাবে বেলা ১২টায়। একই দিনে ট্রেনটি বেলা দেড়টায় খুলনা ছেড়ে সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ পৌঁছাবে কলকাতায়।”
জানা যায়, খুলনা-কলকাতার মধ্যে ১৭২ কিলোমিটার দূরত্বের প্রায় ৯৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে এবং ৭৭ কিলোমিটার ভারত অংশে পড়েছে।
বৃহস্পতিবার ভারতের ঋণ সহায়তায় নির্মিত দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস রেলসেতু এবং ঢাকা-কলকাতা রুটের মৈত্রী এক্সপ্রেসের জন্য উভয় প্রান্তে বহির্গমন ও কাস্টমস কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন দুই প্রধানমন্ত্রী।
১৯৩৭ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ৯৮২ দশমিক ২ মিটার দৈর্ঘ্যের ভৈরব ও ২১৮ মিটার দীর্ঘ দ্বিতীয় তিতাস সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। নতুন দুটি সেতু হওয়ার ফলে ক্রসিং ছাড়াই ডাবল লাইনে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এ দুটি প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত এক হাজার কোটি টাকার মধ্যে ভারত ঋণ দিয়েছে ৮২৬ কোটি ২০ লাখ টাকা।
চালু হবে আরো ট্রেন
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রেল কানেকটিভিটির সম্প্রসারণে দুই দেশই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে এদিন উদ্বোধনের সময় বলেন হাসিনা ও মোদি।
শেখ হাসিনা বলেন, “৬৫-পূর্ববর্তী সময়ে দু’দেশের মধ্যে যে রেল সংযোগগুলো চালু ছিল সেগুলোর সব কটিই পুনঃস্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিছু ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে। বাকিগুলিও চালু হওয়ার পথে।”
দুই দেশের রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে পেট্রাপোল-বেনাপোল, গেদে-দর্শনা, রাধিকাপুর-বিরল ও সিঙ্গাবাদ-রোহনপুর-এই চারটি রেল সংযোগে যাত্রী ও পণ্য চলাচল করছে। আগামী দিনে আগরতলা-আখাউড়া, করিমগঞ্জ-মহিসবাথান, বেলোনিয়া-ফেনি রেল সংযোগগুলো চালু করা হবে।
বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার তৌফিক হাসান বেনারকে বলেন, “নতুন রেল যোগাযোগ বাংলাদেশের মানুষের গতিশীলতার চাহিদাকে পূরণ করবে।”
বরিশাল এক্সপ্রেস থেকে বন্ধন এক্সপ্রেস
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর কলকাতা-খুলনা ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও এত দিন ট্রেনটি চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে ২০০১ সালে এই রুটে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
সাবেক পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা ও বর্তমানে কলকাতা নিবাসী রতন বিশ্বাস স্মৃতিচারণ করে বেনারকে বলেন, “কলকাতা ও খুলনার মধ্যে আগে যে ট্রেনটি চলাচল করত সেটি ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’ নামে পরিচিত ছিল। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বেনাপোল-পেট্রাপোল হয়ে খুলনা পর্যন্ত যাওয়া ট্রেনটি পূর্ববঙ্গের মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিল।”
দু’দেশের মধ্যে ইস্টবেঙ্গল এক্সপ্রেস (গেদে ও দর্শনা হয়ে শিয়ালদহ থেকে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত) ও ইস্ট বেঙ্গল মেইল (গেদে এবং দর্শনা হয়ে শিয়ালদহ থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত) নামে আরও দুটি ট্রেন চালু ছিল বলেও তিনি জানান।
বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গেদে ও দর্শনা হয়ে চলাচল করছে যাত্রীবাহী ট্রেন মৈত্রী এক্সপ্রেস। ২০০৮ সালে ১৪ এপ্রিল উদ্বোধন হওয়া ট্রেনটি কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে যাতায়াতকারী মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
যাত্রার শুরুতেই শুল্ক পরীক্ষা
এখন থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চলাচলকারী যাত্রীবাহী ট্রেনের যাত্রীদের আর সীমান্তবর্তী স্টেশনে শুল্ক পরীক্ষার জন্য মালামাল নামানোর দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেই বলেন, “সীমান্তে যাত্রীদের তিন ঘণ্টা আটকে থাকতে হতো। নতুন ব্যবস্থায় যাত্রীদের সুবিধাই হবে।”
“যাত্রীরা যখন ট্রেনে উঠবেন তখনই কাস্টমস পরীক্ষা ও অভিবাসনের কাজ শেষ হবে। যাত্রা শেষে তারা মালামাল নিয়ে গন্তব্যে চলে যেতে পারবেন। ফলে যাত্রীদের সুবিধাই হবে,” বলেন ভারতের শুল্ক আধিকারিক এস তালুকদার।
ঢাকা-কলকাতা নিয়মিত যাতায়াতকারী যাত্রী শহীদুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “ট্রেন থেকে নেমে সীমান্তের দুদিকে শুল্ক পরীক্ষা ও অভিবাসনের জন্য যাত্রীদের নানারকম ভোগান্তি পোহাতে হতো। বিশেষ করে মহিলা ও প্রবীণ যাত্রীদের মালামাল নামানোর দুর্ভোগ ছিল অবর্ণনীয়। এখন থেকে সেই ঝামেলা গেলা, সময়ও বাঁচল।”