মণিপুরে দুই নারীকে নগ্ন করে হাঁটানোর ভিডিও, ভারতজুড়ে তোলপাড়
2023.07.20
কলকাতা
মণিপুরে চলমান জাতিগত বিরোধ ও সহিংসতা উস্কে দিয়েছে দুই নারীকে নগ্ন করে হাঁটানোর একটি ভিডিও, যা নিয়ে ভারতের সংসদ, রাজনীতি ও উচ্চ আদালতে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
ঘটনার প্রায় আড়াই মাস পর ওই ভিডিওটি গত বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা দেশটির রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বৃহস্পতিবার বিষয়টি নিয়ে প্রবল হট্টগোলের কারণে সংসদের দু’কক্ষের অধিবেশন ওই দিনের জন্য মুলতবি করতে হয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বৃহস্পতিবার বাদল অধিবেশন শুরুর আগে সংসদ ভবনের সামনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, “মণিপুরের ঘটনা যে কোনো সভ্য সমাজের পক্ষে লজ্জার। ওই ঘটনার জন্য দেশের ১৪০ কোটি মানুষের মাথা হেঁট হয়ে গেছে।”
“মণিপুরের নারীদের সঙ্গে যা হয়েছে, তা কখনো ক্ষমা করা যাবে না,” বলেন মোদি।
কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিস্তারিত বিবৃতি দাবি করেন।
এদিন সংসদের উচ্চ কক্ষ রাজ্য সভায় খাড়গে বলেন, “মণিপুর জ্বলছে। নারীরা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। নগ্ন করে নারীদের হাঁটানো হচ্ছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ সময় ধরে নীরবতা পালন করে চলেছেন।”
মণিপুরের ঘটনা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার টুইটারে লেখেন, “মণিপুরের ভয়াবহ ভিডিওটি দেখে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। দুই নারীর ওপর উন্মত্ত জনতার নির্মমতা দেখে মনে তৈরি হয়েছে ক্রোধ। প্রান্তিক শ্রেণির নারীদের ওপর যে হিংসা হয়েছে, তা দেখার কষ্ট এবং যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।”
আড়াই মাসের সহিংসতায় নিহত ১৪২
মণিপুরে আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে উপত্যকার বাসিন্দা হিন্দু মেইতেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে পাহাড়ের খ্রিস্টান কুকি ও নাগা জনগোষ্ঠীর জাতিগত সহিংসতা চলছে। আনন্দবাজারসহ সংবাদ মাধ্যম বলছে, এই সহিংসতায় প্রায় দুইশ মানুষ নিহত হয়েছেন। ঘরছাড়া হয়েছেন অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ।
তবে সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা মণিপুরের মুখ্যসচিবের প্রতিবেদনে ১৪২জন মারা যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
মণিপুরের দীর্ঘ সময় ধরে চলা সহিংসতার ঘটনা সামাল দিতে না পারায় অধিকাংশ বিরোধী দল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিজেপি শাসিত রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহের পদত্যাগ দাবি করেছে।
কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম এক টুইটার বার্তায় বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর উচিত, মণিপুরের ব্যর্থ সরকারকে বরখাস্ত করে সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা।”
মণিপুর নিয়ে বিরোধীদের দাবি অনুযায়ী, সরকার আলোচনা করতে রাজি বলে জানান প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। তিনি বলেন, “সংসদে মণিপুর ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে। সরকারের তরফ থেকে এ নিয়ে জবাব দেওয়া হবে।”
কংগ্রেস সংসদ সদস্য গৌর গগৈ টুইট করে বলেন, “সরকারের ব্যর্থতার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মণিপুরের জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।”
সুপ্রিম কোর্টের উদ্বেগ
মণিপুরে দুই নারীকে নগ্ন অবস্থায় হাঁটানোর ভাইরাল ভিডিও নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বৃহস্পতিবার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এই ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। তিনি সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে বলেন।
এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, “সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ক্ষেত্রে নারীদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা সংবিধান ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে মারাত্মক নিদর্শন।”
তিনি এই ঘটনায় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়েছেন।
মূল অভিযুক্তসহ গ্রেপ্তার ২
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বুধবার ওই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পরেই সক্রিয় হয়েছে মণিপুরের পুলিশ। ঘটনার ৭৭ দিন পরে মূল অভিযুক্তসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে সরকারিভাবে দাবি করা হয়েছে।
বিজেপি শাসিত রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান, “ঘটনার মূল অভিযুক্তসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত চলছে। অপরাধীদের যাতে মৃত্যুদণ্ড হয়, তা নিশ্চিত করব আমরা।”
ভাইরাল ভিডিও প্রসঙ্গে মণিপুর পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট কে মেঘচন্দ্র সিং বুধবার এক বিবৃতিতে বলেন, অজ্ঞাতপরিচয় সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারীদের দ্বারা দুই নারীকে নগ্ন করে হাঁটানোর ঘটনাটি ঘটেছিল ৪ মে। থৌবল জেলার নংপোক সেকমাই থানায় ইতোমধ্যেই অপহরণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করা হয়েছে।
পুলিশের এফআইআর অনুযায়ী, ৪ মে একটি কুকি পরিবারের তিন নারীসহ পাঁচজন আতঙ্কে বনে লুকিয়েছিলেন, পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে। দুষ্কৃতিকারীরা পুলিশের হাত থেকে তাঁদের ছিনিয়ে নেয়। এরপর ৫৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে খুন করা হয়। দুই নারীকে নগ্ন করে হাঁটানো হয়। ২১ বছর বয়সী এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ভিডিও সরিয়ে ফেলার নির্দেশ
সংবাদ সংস্থা এএনআই সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে জানায়, টুইটার এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে দুই নারীকে নগ্ন অবস্থায় হাঁটানোর ভাইরাল ভিডিও সরাতে নির্দেশ দিয়েছে ভারত সরকার।
ভারতের জাতীয় নারী কমিশনের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানানো হয়, আনুষ্ঠানিকভাবে টুইটার ইন্ডিয়ার পাবলিক পলিসির প্রধানকে মণিপুরে দুই নারীকে নগ্নভাবে হাঁটানোর অমর্যাদাকর ভিডিও সরিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে।
কমিশনের মতে, ভিডিওতে নারীদের পরিচয় প্রকাশ্যে আনার বিষয়টি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ইতোমধ্যেই সরকারের দাবি অনুযায়ী ভিডিওটি বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করা বন্ধ করে দিয়েছে টুইটার কর্তৃপক্ষ।
অশান্তির সূত্রপাত
সরকারি হিসেবে, মণিপুরের জনসংখ্যা প্রায় ৩৪ লাখ। রাজ্যটিতে ভৌগলিকভাবে মাত্র ১০ শতাংশ জমির অধিকারী হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে হিন্দু মেইতেই সম্প্রদায়ের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ।
অন্যদিকে ৯০ শতাংশ জমির অধিকারী পাহাড়ের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কুকি ও নাগা জনগোষ্ঠীর আদিবাসীরা জনসংখ্যার দিক থেকে মাত্র ৪০ শতাংশ। তারা সরকার প্রতিশ্রুত সব ধরনের সুবিধা পান।
হিন্দু মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ অনেক দিন ধরেই তফসিলি উপজাতির স্বীকৃতির দাবি করছেন। সম্প্রতি তারা মণিপুর হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়।
মেইতেই সম্প্রদায়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গত ১৪ এপ্রিল ওই সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতির তালিকাভুক্ত করা যায় কি না তা বিবেচনা করে দেখতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়।
তফসিলি উপজাতি তালিকার আওতায় এলে সরকারি চাকরি, কলেজে ভর্তি ও নির্বাচনে আসন সংরক্ষণের আওতায় চলে আসবে তারা।
এই দাবি ও প্রস্তাবের প্রতিবাদে গত ৩ মে অল ট্রাইবাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন মণিপুর আদিবাসী সংহতি মার্চের ডাক দেয়। সেখান থেকে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
গত ৭৫ দিন ধরে চলা উত্তেজনা এখনও কমার লক্ষণ নেই, বরং ক্রমশ তা জাতিগত দাঙ্গায় রূপ নিয়েছে বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছে।
বৃহস্পতিবার চূড়াচাঁদপুরে আদিবাসীরা আলাদা প্রশাসনের দাবি জানিয়ে বিশাল মিছিল করেছে। মিছিল থেকে দাবি তোলা হয়েছে, মণিপুর থেকে আলাদা হওয়াই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান।
মণিপুর পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট এক বিবৃতিতে জানান, অনেক জায়গায় গুলি চলছে। উত্তেজনাও রয়েছে কিছু জায়গায়। ফলে উপত্যকার পাঁচ জেলা ও চূড়াচাঁদপুরে কারফিউ জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীকে কঠোর হতে বলা হয়েছে।