আসামের নাগরিক নিবন্ধন দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
2019.08.21
ঢাকা
আসামের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগ থাকলেও বিষয়টিকে ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুব্রানিয়াম জয়শঙ্কর।
মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকের পরে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন বুধবার বেনারকে বলেন, “আসামের এনআরসির বিষয়টি আমরা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে উত্থাপন করেছিলাম। ওনাকে বলেছি, এমনিতেই ১১ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে আমরা কষ্টে আছি, আবার ওখানে (আসামে) ৪০ লাখ মানুষের কথা বার্তা শুনছি। এগুলো নিয়ে আমাদের মিডিয়া হই-চই করছে।”
“উনি (ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী) তখন বলেছেন, এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
“বিষয়টা নিয়ে বাংলাদেশ দুশ্চিন্তা না করলেও সজাগ থাকবে,” মন্তব্য করেন তিনি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত সংলগ্ন ভারতীয় রাজ্য আসামের এনআরসির যে তালিকা করা হচ্ছে তাতে নাগরিকত্ব বঞ্চিত হতে পারে সেখানকার ৪০ লাখের বেশি বাসিন্দা।
আসামের এনআরসিকে ভারত ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ বললেও বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশকে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “আসামের এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের এক ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ তো আছেই। পূর্বে এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ।”
তিনি বলেন, “১৯৯৮-১৯৯৯ সালের দিকে অবৈধ ঘোষণা দিয়ে অনেককে বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল ভারত। তাই বাংলাদেশের সতর্ক থাকা উচিত।”
ড. দেলোয়ার মনে করেন, “যেহেতু এখনো কাউকে সীমান্ত পার করিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করানোর চেষ্টা করা হয়নি, এ জন্য অফিশিয়ালি বাংলাদেশ কোনো কিছু বলেনি। তবে হয়তো আনঅফিসিয়ালি সেটা প্রকাশ করেছে।”
তবে তিনি বলেন, “আসামে এখন পর্যন্ত যা হচ্ছে তাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বরং ভারতের মানুষেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথমবার বাংলাদেশ সফর করলেন জয়শঙ্কর। গত সোমবার রাতে ঢাকায় পৌঁছে তিন দিনের সফর শেষে বুধবার সকালে ঢাকা ছাড়েন তিনি।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে নিরাপত্তা, কানেকটিভিটি, পানি বণ্টন সহযোগিতা, মানুষে মানুষে যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কাশ্মীরে ইস্যু ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়: বাংলাদেশ
জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা ও বিশেষ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের বিষয়টিকে ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু’ বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ।
বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর শেষে এই অবস্থান জানাল বাংলাদেশ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ মনে করে, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সব সময়ই আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতায় বিশ্বাসী। একই সঙ্গে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা এই অঞ্চলের সব দেশের জন্য অগ্রাধিকার।’
উল্লেখ্য, ভারতীয় সংবিধানের একটি অস্থায়ী বিধান ৩৭০ ধারার আওতায় জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা ও বিশেষ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর এই ধারা দেশটির সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। এর আওতায় জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের আওতামুক্ত রাখা হয় (অনুচ্ছেদ ১ ব্যতিরেকে) এবং ওই রাজ্যকে নিজস্ব সংবিধানের খসড়া তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়।
৩৭০ ধারা অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, অর্থ এবং যোগাযোগ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে জম্মু কাশ্মীরে হস্তক্ষেপের অধিকার ছিল না। এমনকি জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের সম্মতি ব্যতীত কেন্দ্র বা সংসদেরও কোনো আইন প্রণয়নের অধিকারও ছিল না ।
তবে গত ৫ আগস্ট সেই ৩৭০ নম্বর ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বাংলাদেশ সফরকালে আলোচিত কাশ্মীর ইস্যুতে কোনো মন্তব্য করতে চাননি জয়শঙ্কর।
তিস্তা নিয়ে সুখবর নেই
মোদী সরকার দু’দেশের অভিন্ন নদী তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসলেও এ সফরে নতুন কোনো আশা কথা শোনাতে পারেননি জয়শঙ্কর।
তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমাদের মনোভাব আপনারা জানেন। এ বিষয়ে আমাদের একটা প্রতিশ্রুতি আছে, আর সেটা এখনো বদলায়নি।”
তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে জয়শঙ্কর বলেন, বাংলাদেশের জন্য পনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুই দেশের জন্য লাভজনক হয়—এমনটা বিবেচনায় নিয়ে ৫৪টি নদীর অভিন্ন পানিবণ্টনের বিষয়ে একটি ফর্মুলা বের করতে বাংলাদেশ-ভারত রাজি হয়েছে।
তবে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, “দু’পক্ষের মধ্যকার আলোচনা ‘ফলপ্রসূ’ হয়েছে। বেশ কিছু বিষয়ে ‘কম-বেশি ঐকমত্যে’ পৌঁছানো গেছে। তবে এসবের বিস্তারিত কিছু তিনি জানাননি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এহসানুল হক বেনারকে বলেন, “২০১১ সালে সব ধরনের প্রস্তুতি সত্ত্বেও তিস্তা চুক্তি হয়নি। যা বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার।”
“গত আট বছর ধরে বিষয়টি না হওয়ায় অনেক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তবে আশা করি, নরেন্দ্র মোদীর সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে এসে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগ দেবে। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশের সাথেই ভারতের সবচেয়ে সুসম্পর্ক বিরাজ করছে,” বলেন তিনি।
জাতীয় স্বার্থে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চায় ভারত
এদিকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের নিজ দেশে নিরাপদ, দ্রুত ও টেকসই প্রত্যাবাসনের ভারত সব সময় সমর্থন দিয়ে আসছে। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার-এই তিন দেশের জাতীয় স্বার্থেই এটা করা জরুরি।
“বাংলাদেশ থেকে এই বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে এবং রাখাইন রাজ্যের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে আমরা সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছি। এরই মধ্যে রাখাইনে ভারত ২৫০টি বাড়ি হস্তান্তর করেছে,” বলেন তিনি।
অধ্যাপক এহসানুল হক বলছিলেন, “রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান না হলে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে নিরাপত্তা হুমকি দেখা দিতে পারে। এ কারণেই ভারত এই সমস্যাকে জাতীয় স্বার্থ বলে মনে করছে।
তবে ভারত আশানুরূপ ভূমিকা পালন করেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কাশ্মীরে অস্থিরতা দেখা দেওয়ার পরে ভারত বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করতে চাইবে।”
শেখ হাসিনাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মঙ্গলবার বিকেলে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার হাতে মোদীর আমন্ত্রণপত্র তুলে দেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের জানান, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীকে দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ আমন্ত্রণের জন্য নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।