দুই ইসলামি গ্রুপের সংঘর্ষে মাদ্রাসা ছাত্র নিহত, আহত অর্ধ শতাধিক

জেসমিন পাপড়ি
2018.02.27
ঢাকা
ওয়াজ মাহফিলকে ঘিরে দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ওয়াজ মাহফিলকে ঘিরে দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ছবিটি সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার আমবাড়ি গ্রাম থেকে তোলা। ২৭ ফেরুয়ারি ২০১৮।
বেনারনিউজ

ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দেওয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হয়েছেন। সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় সোমবার রাত ১১টা থেকে দুইটা পর্যন্ত আটরশি পিরের অনুসারী ও কওমি মাদ্রাসাপন্থীদের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি।

ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত মতাদর্শগত পার্থক্যের জের ধরে এই সংঘর্ষ হয় বলে জানান স্থানীরা। এ সময় আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বাড়িঘরে বিচ্ছিন্ন হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

জৈন্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খান মো. মঈনুল জাকির বেনারকে জানান, নিহত ছাত্র মোজাম্মিল হোসেন (২২) হরিপুর মাদ্রাসার দাওরা হাদিস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

মাদ্রাসা ছাত্র নিহতের ঘটনায় মঙ্গলবার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্থানীয় প্রশাসন। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সোমবার রাতে জৈন্তাপুরের আমবাড়ি এলাকায় একটি ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করে আটরশি পিরের অনুসারীরা। সেখানে ইসলাম বিরোধী কোনো বক্তব্য দেওয়া হয় কিনা তা পর্যবেক্ষণের জন্য কওমিপন্থী স্থানীয় অপর একদল মুসল্লি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

জানা যায়, এক পর্যায়ে ওয়াজ মাহফিলে একজন মাওলানার দেওয়া বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দু’পক্ষের কয়েক হাজার সমর্থক লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় আশপাশের আমবাড়ি, ঝিঙ্গাবাড়ি ও কাঁঠালবাড়ি গ্রামের বেশ কিছু বাড়িঘরে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়। বিক্ষুব্ধরা এ সময় সিলেট-তামাবিল সড়কও কয়েক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে।

পুলিশের উপস্থিতিতে রাত তিনটার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। গতকাল পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুরো এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, আটরশি পিরের অনুসারী ও কওমি মাদ্রাসা পন্থীদের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য রয়েছে। আটরশি পিরের অনুসারীরা সুফি মতাদর্শী। আর কওমি মাদ্রাসার সমর্থকেরা কঠোরভাবে ইসলামি অনুশাসন ও বিধিবিধান মেনে চলে।

আটরশি পিরের অনুসারীদের মাজার, ওরস—এসবের প্রতি ঝোঁক বেশি। কওমিপন্থীরা ইসলাম অনুশাসন মানার বিষয়ে আটরশি সমর্থকদের পথভ্রষ্ট মনে করে।

পুলিশ জানায়, জৈন্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি রয়েছেন ১৪ জন।

এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান ওসি মঈনুল জাকির।

ইসলাম বিরোধী মন্তব্যের অভিযোগ

জমিয়তে উলামা ইসলাম বাংলাদেশ সিলেট মহানগর শাখার প্রচার সম্পাদক মাওলানা আতিকুর রহমান বেনারকে বলেন, জৈন্তাপুর এলাকার মুরুব্বিদের সিদ্ধান্ত ছিল যারা মাজার ভক্ত তারা ওয়াজ মাহফিল করতে পারবে। তবে বিভিন্ন এলাকা থেকে বক্তা আনলেও স্থানীয় একজন বিজ্ঞ আলেমকে ওই মাহফিলে দাওয়াত করতে হবে। তিনি উপস্থিত থেকে আগত অতিথি বক্তা কোরআন হাদিসের বাইরে কোনো বক্তব্য দেন কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করবেন।

আতিকুর রহমান জানান, “হরিপুর মাদ্রাসার সিনিয়র মোহাদ্দেস মাওলানা আবদুস সালামকে ওই মাহফিলে দাওয়াত করা হয়। তাঁর উপস্থিতিতে আগত অতিথি বক্তা গাজি সোলায়মান হোসাইন বক্তব্য রাখছিলেন। এ সময় তিনি কোরআন বিরোধী উক্তি করলে আবদুস সালাম আপত্তি জানান।”

“আর তখনই আয়োজকেরা সালামের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। তাকে বাঁচাতে কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা এগিয়ে গেলে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে তাঁদের ওপরও হামলা চালানো হয়। এতে ঘটনাস্থলে মোজাম্মিল মারা যায়,” জানান আতিকুর রহমান।

কওমিপন্থী জমিয়তে উলামা বাংলাদেশের শীর্ষ নেতা অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বেনারকে জানান, “এ ঘটনায় এখনো মামলা করা হয়নি, তবে সংগঠনের পক্ষ থেকে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।”

তদন্ত কমিটি গঠন

জৈন্তাপুরের সংঘর্ষের ঘটনা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. শহিদুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) সন্দীপ কুমার সিংহ ও জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌরিন করিম।

“ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পাশাপাশি প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে আলাপ করেছি,” জানান শহিদুল ইসলাম চৌধুরী।

মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সংঘর্ষে তিনটি গ্রামের ৪৫টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে বলে জানান সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. রাহাত আনোয়ার।

মঙ্গলবার সকালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের ২০ কেজি চাল, নগদ ৩ হাজার টাকার পাশাপাশি ডাল, আলু, পেঁয়াজ, মরিচ, লবণ, মোমবাতি, ম্যাচসহ রান্না করা খাবারও বিতরণ করা হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।