সংসদে বিরোধী দল ঠিক করে দিল সরকারি দল আওয়ামী লীগ

অয়ন আমান
2023.12.18
ঢাকা
সংসদে বিরোধী দল ঠিক করে দিল সরকারি দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে প্রচারণার প্রথম দিনেই রাজধানী জুড়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের পোস্টার দেখা যায়। ছবিতে ধানমন্ডি এলাকায় ঢাকা-১৩ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পোস্টার লাগানো হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩।
সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ

আসন ভাগাভাগি করে সমঝোতার নির্বাচনে যোগ দেওয়ার পর জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় এবারও জাতীয় পার্টির অবস্থান নিশ্চিত হয়েছে।  সরকারি দলের পক্ষ থেকে বিরোধী দল ঠিক করে দেওয়ার এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না বলে মত দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিরোধী দলগুলো।

দর কষাকষির মাধ্যমে সমঝোতায় আসার পর আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে রোববার সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এটা তাদের ‘নির্বাচনী কৌশল’।  সরকার ও মিত্রদের এই কৌশল ঠিক করার পরদিন সোমবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে  নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়েছে।

নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের  এক পর্যায়ে ভোট বর্জন করা দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই সমঝোতাকে ভাগ-বাটোয়ারার নির্বাচন বলে আখ্যা দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজনদের অনেকেই মনে করছেন, সরকারি দল আওয়ামী লীগ বিরোধী দল ঠিক করে দেওয়ায় নির্বাচনে ভোটারদের পছন্দের প্রার্থী বেছে নেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল সোমবার বেনারকে বলেন, “নির্বাচন মানে বেছে নেওয়ার একটা পদ্ধতি।  কিন্তু আমাকে একই জিনিস দিয়ে বলা হচ্ছে, তুমি বেছে নাও; সেটা তো আর বেছে নেওয়া হলো না! একই বলয়ের মানুষ, একই দলের মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

 “ডামি প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী যারা হয়েছেন, তারা প্রকৃতপক্ষে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগেরই লোকজন।  যাকেই আমি নির্বাচিত করি, সে একই ধরনের কাজ করবে এবং সংসদে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে,” যোগ করেন তিনি।

এই নির্বাচন অর্থহীন আখ্যা দিয়ে সুলতানা কামাল বলেন, “সংসদে ভিন্ন মতের কারও নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ এখানে নেই।  যেভাবে আগেও সংসদে নীতি নির্ধারিত হয়েছে কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে এবারও তাই হবে।”

অংশগ্রহণমূলক হবে না: রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ

এই সমঝোতা প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম বেনারকে বলেন, “ নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২৭টি রাজনৈতিক দলই মূলত আওয়ামী লীগ ঘরানার।  প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ১৬টি রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনের সঙ্গে নেই।  তাই এটাকে অংশগ্রহণমূলক কীভাবে বলবো? জনগণের একটি বিশাল অংশ এই নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত নয়।  তারা হয়তো ভোট দিতে যাবে না।”

শামসুল আলম আরও বলেন, “আওয়ামী লীগ যেহেতু স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রত্যাহার করেনি, জাতীয় পার্টির এই নির্বাচনে বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও কিন্তু আছে।  শেষ মুহূর্তে স্বতন্ত্ররাই বিরোধী দল হয়ে যেতে পারে।”

“এটা আমাদের কাছে নির্বাচন মনে হচ্ছে না।  কারণ সব দল ও মতের অংশগ্রহণ নেই, ভিন্ন মতের কেউ এই নির্বাচনে নেই।  সরকারের উদ্যোগেই ভিন্ন মত সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।  তাই এটা একদলীয় নির্বাচন বলা যায়," যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ জাসদ সভাপতি ও প্রবীণ রাজনীতবিদ শরীফ নুরুল আম্বিয়া বেনারকে বলেন, “কোনোভাবেই এটাকে জাতীয় নির্বাচন বলা যায় না।  জাতীয় নির্বাচনের পর্যায়ে এটা পড়ে না, বড়জোর ঘরোয়া নির্বাচন বলা যায়।  দেশবাসী জাতীয় নির্বাচন বলতে যেটা বোঝে তাহলো সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল তাতে অংশ নেবে।  বাস্তবে এক সময় আওয়ামী লীগের মহাজোটে যারা ছিল, তারা ভাগ-বাটোয়ারা করে এই নির্বাচন করছে। ”

এটা নতুন কিছু না: ওবায়দুল কাদের

সরকারি দল আওয়ামী লীগ বিষয়টি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছে।  দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রোববার সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচন একটা কৌশল।  আমরা এবার কৌশলটা এভাবেই ঠিক করেছি।  আমরা রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি আলোচনা করেছি আসন ভাগাভাগি নিয়ে।  শেষ পর্যন্ত কিছু জায়গায় আসন ভাগাভাগি করেছি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করার জন্য।”

জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দল, তাদের সঙ্গে আপনারা সমঝোতা করলেন, তাহলে বিরোধী দল কারা হবে—গণমাধ্যমকর্মীর প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, “এটা ঠিক হবে নির্বাচনের পর।”

তিনি আরও বলেন, এটা নতুন কিছু না।  গত নির্বাচনে হয়েছে, তার আগের নির্বাচনেও হয়েছে।  

রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, “তারা (জাতীয় পার্টি) কিছু আসনে আওয়ামী লীগ থেকে সাপোর্ট চেয়েছিলেন।  তারা আরও বড় সংখ্যায় প্রস্তাব করেছিলেন, আমরা ২৬টি আসনে সমঝোতা করতে পেরেছি।”

এসব আসনে নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন,  এর বাইরে অন্যান্য আসনে তারা লাঙ্গল নিয়ে প্রতিযোগিতা করবে।

“প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে এসব অ্যাকোমোডেশনের প্রয়োজন হয়তো ছিল না,” যোগ করেন তিনি।

সরকারের আশ্বাসে সন্তুষ্ট জাপা

তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও শেষ মুহূর্তে সরকারের আশ্বাসে সন্তুষ্ট হওয়ার কথা জানিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।

রোববার বিকেলে বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “নির্বাচন ভালোভাবে করতে সরকার নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সেই কারণে আমরা জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের পক্ষ থেকে আমরা এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব এবং নির্বাচন যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়, প্রতিযোগিতামূলক হয়—আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাব।”

নির্বাচনের নামে প্রহসন: বিএনপি

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সোমবার বেনারকে বলেন, “প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে।  এই নির্বাচনে শুধু সরকারি দল, সরকারি দলের জোট, মহাজোট এবং সরকারের তৈরি করা কয়েকটি রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে।  এখানে কোনো প্রতিপক্ষ নেই।  তাই প্রতিযোগিতার প্রশ্নই ওঠে না।”

তিনি বলেন, “যে নির্বাচনে কোনো প্রতিপক্ষ থাকে না, প্রার্থী সরকারি দল ঠিক করে দেয়; সেটা তো নির্বাচনই না! এটা একটি প্রহসন।”

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে সিইসি

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সোমবার সাংবাদিকদের বলেছেন, “এই নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দল (বিএনপি) অংশগ্রহণ করছে না।  আমরা প্রথম থেকেই তাদের নির্বাচনে আসার আহ্বান জানাচ্ছিলাম।  তারা অংশগ্রহণ করলে নির্বাচনটা আরও বেশি ইনক্লুসিভ ও পার্টিসিপেটরি হতো।”

এর আগে আপনি বলেছিলেন বিএনপি অংশ নিলে দেশের মঙ্গল, এখন বিএনপি অংশ নিচ্ছে না—এ প্রসঙ্গে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “যেটা আগে বলেছি, অংশগ্রহণ করলে নির্বাচন অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক হবে।  না নিলে কী হবে সেখানে আমি যাচ্ছি না।  অংশ নিলে ভালো হতো সেটা সবাই অনুভব করেছে।”

এক নজরে ভোটের চিত্র

নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম গত রোববার সাংবাদিকদের বলেন, মোট দুই হাজার ৭১৬টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল।   প্রার্থিতা প্রত্যাহার শেষে মোট বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮৯৬।

এখন মোট ২৭টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে।  

৩২ আসনে আ. লীগের প্রার্থী প্রত্যাহার

গত রোববার নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে ৩২টি আসন থেকে দলীয় প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

দলটির দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের বৈধ প্রার্থী ২৯৩টি।  ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে তিনটি দলকে ছয়টি আসন দেওয়া হয়েছে।  বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিকে দুটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদকে তিনটি ও জাতীয় পার্টিকে (জেপি) একটি আসন দেওয়া হয়েছে।  এ ছাড়া জাতীয় পার্টির জন্য ২৬টি আসনে প্রার্থী প্রত্যাহার করা হয়েছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।