জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এক নারী ও খ্রিষ্টান ব্যবসায়িকে হত্যার অভিযোগ

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.06.05
160605-BD-son-1000 চট্টগ্রামে সন্ত্রাস–বিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তারকে নৃশংসভাবে হত্যার পর স্বজনদের সঙ্গে তাঁদের শোকাহত শিশুপুত্র। জুন ৫, ২০১৬।
এএফপি

গত প্রায় দেড় বছরে কমপক্ষে ৪৮টি গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটলেও রবিবার এই প্রথম একজন নারী নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। পুলিশের ধারনা, সাম্প্রতিক সময়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠা জঙ্গিরা তাঁকে হত্যা করেছে।

ওই নারীর নাম মাহমুদা আক্তার মিতু(৪০), যিনি চট্টগ্রামের আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী। জঙ্গিবাদবিরোধী বেশ কয়েকটি অভিযানে বাবুল নেতৃত্ব দেন।

গতকাল উত্তরাঞ্চলীয় জেলা নাটোরে আরও একজন খ্রিষ্টান ব্যবসায়িকে দুর্বৃত্তরা হত্যা করেছে, যার নাম সুনীল গোমেজ। পুলিশের সন্দেহ, এটাও জঙ্গিদের কাজ।

 

একইদিনে দুটি হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে চরম উদ্বেগ–উৎ​কন্ঠা সৃষ্টি করেছে। পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে জবাই ও গুলি করে হত্যার ঘটনাটি বাহিনীর মনোবলের ওপর প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।

চট্টগ্রামে এই ঘটনার পর সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পুলিশ বাহিনীর মনোবলের ওপর এই হত্যাকাণ্ডের প্রভাব পড়বে না।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, “জঙ্গিরা এই হত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ কর্মকর্তাদের মানসিকভাবে দুর্বল করতে এ হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকতে পারে।”

এদিকে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী খুন হওয়ার পর গতকালই পুলিশ সদর দপ্তর থেকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং জেলার পুলিশ সুপারদের কাছে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। তাঁদের আরও সতর্ক ও নজরদারি বাড়াতে বলা হয় খুদে বার্তায়।

“প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করা হচ্ছে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবির জঙ্গিরা জড়িত থাকতে পারে। এদের গ্রেপ্তারের সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে,” বেনারকে জানান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মোখলেসুর রহমান।

 

হত্যাকাণ্ডের বিবরণ

গতকাল সকাল সাতটার দিকে বাসা থেকে ১০০ গজ দূরত্বে নগরের পাঁচলাইশ থানার জিইসি মোড়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। ছেলেকে স্কুলের বাসে তুলে দিতে গিয়েছিলেন মাহমুদা খানম।

জঙ্গিবিরোধী অভিযানে এসপির সক্রিয় ভূমিকার কারণে তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করা হতে পারে বলে ধারণা পুলিশের। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, দুর্বৃত্তরা মোটরসাইকেলে করে এসেছিল।

নগরের ও আর নিজাম আবাসিক এলাকায় একটি বাড়ির সপ্তম তলায় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন বাবুল আক্তার। বাসায় তাঁর স্ত্রী, ছেলে আকতার মাহমুদ মাহির, মেয়ে তাবাসসুম তাজনীন ছিলেন।

ঘটনার পর সকাল পৌনে আটটায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে চারপাশে ঘিরে রাখেন।

“নিহত মাহমুদার মাথার বাঁ পাশে একটি ও শরীরে একটি গুলি লেগেছে। এ ছাড়া সেখান থেকে অব্যবহৃত তিনটি বুলেট উদ্ধার করা হয়,” সাংবাদিকদের জানান সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক মিতশ্রী বড়ুয়া।

তিনি আরও বলেন, হত্যাকারীরা খুব কাছ থেকে গুলি করেছে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কমিশনার মো. ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, “বাবুল আক্তার যেহেতু জঙ্গিদের গ্রেপ্তার ও অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন, সে জন্য জঙ্গিরা এ ঘটনা ঘটাতেও পারে। সব কটি বিষয় সামনে রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।”

 

জীবন নিয়ে শঙ্কা ছিল বাবুলের

চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার থাকাকালে গত বছরের অক্টোবরে নগরের কর্ণফুলীর খোয়াজ নগর থেকে শুরু করে ডিসেম্বর পর্যন্ত হাটহাজারীর আমিনবাজারে টানা অভিযান চালিয়ে অস্ত্র-গুলিসহ জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করেন। খোয়াজ নগরে অভিযান চালানোর সময় জঙ্গিরা তাঁকে লঞ্চ করে গ্রেনেড ছুড়লেও তিনি বেঁচে যান। ওই অভিযানেই চট্টগ্রামে জঙ্গিদের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়।

এরপর থেকে বাবু আক্তার নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কায় থাকলেও পিছু হটেননি অভিযান থেকে। কিন্তু পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি সব সময় শঙ্কায় থাকতেন।

বাবুল আক্তার সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সুপার হন। গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দেন তিনি। তাঁর কর্মস্থল এখনো নির্ধারিত হয়নি। স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি চট্টগ্রামে যান।

খ্রিষ্টান মুদি দোকানদারকে হত্যা

নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া খ্রিষ্টানপাড়ায় সুনীল গোমেজ (৬০) নামের এক মুদি ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তাঁর ঘাড়ের পেছনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়।

আলামত দেখে স্থানীয়দের ধারণা এটা জঙ্গি হামলা হতে পারে। রোববার দুপুর ১২টার দিকে নিজ দোকানে তাঁর লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

“ঘাড়ের পেছনের কোপানোর আলামত দেখে মনে হচ্ছে এটা জঙ্গি হামলা হতে পারে,” বেনারকে জানান বনপাড়া ধর্মপল্লির সহসভাপতি ব্যানেডিক গোমেজ।

সুনীল গোমেজ হত্যার প্রতিবাদে বনপাড়া ধর্মপল্লির পক্ষ থেকে বিকেলে বনপাড়া চার্চের সামনে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকজন সমবেত হন এবং বনপাড়া বাজারে নাটোর-পাবনা সড়কে মানববন্ধন করেন। এতে ধর্মীয় নেতারা বক্তব্য দেন।

সুনীল গোমেজের এক মেয়ে রয়েছে। আর একমাত্র ছেলে স্বপন বছরখানেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। মেয়ে স্বপ্নার বিয়ে হয়েছে কয়েক বাড়ি পরে।

স্বপ্না গোমেজ স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, তাঁর বাবা নিরীহ মানুষ। তিনি বিভিন্ন গির্জায় মালির কাজ করতেন। অসুস্থ হয়ে পড়ায় কাজ থেকে অবসর নিয়ে বাড়ির একটি কক্ষে মুদি ব্যবসা করতেন। তাঁর কোনো শত্রু ছিল না।

 

গুপ্তহত্যার শিকার ৪৮

সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৫ জুন পর্যন্ত প্রায় দেড় বছরে কমপক্ষে ৪৮টি গুপ্তহত্যা হয়েছে। এঁদের মধ্যে সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান যেমন আছেন, তেমনি আছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী, সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়।

নিহতদের তালিকায় জাপান ও ইতালির দুই নাগরিক, প্রকাশক, ব্লগার, পীর, ফকির, সাধু, বৌদ্ধভিক্ষু ও ধর্মান্তরিত মুসলিমও রয়েছেন।

জঙ্গিদের দিকে সন্দেহের তীর ছোড়া হলেও এ পর্যন্ত কোনো ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটন হয়নি। জঙ্গি বা হত্যাকারী সন্দেহে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের পর একটি পর্যায়ে গিয়ে সবকিছু আটকে যাচ্ছে। এমনকি জঙ্গি সংগঠনের কথিত দাবি সরকার অস্বীকার করলেও কারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে, তা নিশ্চিত হতে পারছে না।

গত ২২ মে আইন শৃঙ্খলারক্ষা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে স্পর্শকাতর যে ৩৭টি হত্যা মামলার ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ২৫ টির সঙ্গে সরাসরি জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) জড়িত। আটটির সঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংলা বাহিনী টিম এবং বাকিগুলোর সঙ্গে অন্যান্য জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠন জড়িত।

এসব ঘটনায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে তথ্য দিয়েছে ওই কমিটি। যদিও কমপক্ষে ৩০টি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে আইএস।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।