আবার বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা বন্ধ করলো দক্ষিণ কোরিয়া

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.04.16
ঢাকা
আবার বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা  বন্ধ করলো দক্ষিণ কোরিয়া হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্মাল স্কানারে যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।
রয়টার্স

প্রত্যাহারের দুই মাস পর আবারও বাংলাদেশিদের জন্য বন্ধ হলো দক্ষিণ কোরিয়ার ভিসা। বাংলাদেশ থেকে নেগেটিভ সনদ নিয়ে সেখানে গিয়ে ৩৩ জন বাংলাদেশির শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ার প্রেক্ষাপটে ভিসা প্রদান স্থগিত করেছে দেশটি। সিউলে বাংলাদেশ দূতাবাস শুক্রবার এ–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, যার কপি বেনারের হাতে রয়েছে।

বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের চাকরি রক্ষার্থে চলমান কঠোর লকডাউনের কারণে সৌদি আরব, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে দেশে আটকে পড়া ৫৫ হাজার বাংলাদেশিকে সেসব দেশে পৌঁছে দিতে ১৭ এপ্রিল থেকে বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করবে সরকার। তবে অন্যান্য দেশ থেকে প্রবাসীদের বাংলাদেশে আসতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় ভিসা বন্ধ

দক্ষিণ কোরিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম শুক্রবার বেনারকে বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশিদের ভিসা দেয়া শুরু করার পর কয়েকশ বাংলাদেশি কোরিয়ায় আসতে পেরেছেন। যাঁরা এসেছেন তাঁদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৩৩ জন করোনা পজিটিভ। এ কারণে বাংলাদেশিদের ভিসা দেয়া আপাতত বন্ধ রেখেছে দেশটি।”

তিনি বলেন, “শুধু বাংলাদেশিদের জন্য যে ভিসা বন্ধ করা হচ্ছে, তা নয়। অন্যান্য দেশের নাগরিকদের জন্যও ভিসা দেয়া সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে।”

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে ২৩ জুন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা বন্ধ করে দক্ষিণ কোরিয়া। প্রথম ঢেউয়ে গত বছরের জুন-জুলাই মাসে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এরপর তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সংক্রমণের হার শতকরা দুই শতাংশের নিচে নেমে আসলে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশিদের জন্য আবার ভিসা দেয়া শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়া।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান সৈয়দ সাইফুল হক বেনারকে বলেন, “আমরা প্রবাসী ভাইদের বার বার বলে আসছি, ভালো জায়গা থেকে করোনা পরীক্ষা না করে কেউ বিদেশে যাবেন না। কারণ সেখানে উন্নত মেশিনে কারও করোনা থাকলে ধরা পড়বেই। কিন্তু কেউ কেউ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন না।”

তিনি বলেন, “প্রকৃত অবস্থা হলো, অনেকেই পরীক্ষা না করে একটি নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে যান। তাঁরা মনে করেন, জ্বর বা কাশি নেই। কিন্তু তাঁরা বুঝতে চান না যে, জ্বর-সর্দি-কাশি না থাকলেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন।”

সাইফুল হক বলেন, “কোরিয়ায় আমাদের কর্মীসংখ্যা এমনিতেই কম। কিন্তু সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি মজুরি পায় আমাদের কর্মীরা। কিন্তু এভাবে যদি দেশের বদনাম হতে থাকে, তাহলে তারা হয়তো আমাদের কর্মী নেবে না।”

রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম জানান, করোনা মহামারির কারণে গত বছর বাংলাদেশ থেকে কোন কর্মী কোরিয়ায় আসতে পারেননি। বর্তমানে সেখানে প্রায় নয় হাজার বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন। সেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে।

আটকে পড়া প্রবাসীদের জন্য বিশেষ ফ্লাইট

দেশে ফিরে আটকা পড়েছেন কমপক্ষে ৫৫ হাজার বাংলাদেশি কর্মী যাঁরা সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার ও সিঙ্গাপুরে কাজ করেন। তাঁদের অনেকের ইকামার মেয়াদ (কাজের অনুমতিপত্র) খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে।

এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সভাপাতিত্বে আন্ত:মন্ত্রণালয় জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শুক্রবার জানানো হয়, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার ও সিঙ্গাপুরে গমনেচ্ছু আটকে পড়া প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের গমনের জন্য আগামী ১৭ এপ্রিল থেকে বিশেষ ফ্লাইট চালু হচ্ছে।

এতে বলা হয়, “এক্ষেত্রে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সসহ বাংলাদেশি অন্যান্য এয়ারলাইন্স এবং সংশ্লিষ্ট দেশসমুহের ন্যাশনাল ক্যারিয়ারসহ অন্যান্য ক্যারিয়ার বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারবে।”

বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, “ওই পাঁচ দেশে গমনেচ্ছু প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের মধ্যে যাদের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইস্যুকৃত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ক্লিয়ারেন্স রয়েছে, তাদের বিদেশ গমনে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।”

“তবে এসব দেশের ক্ষেত্রে যাদের ভিজিট ভিসা আছে, কিন্তু বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স নেই, তারা বিদেশ গমনে অগ্রাধিকার পাবেন না। ভিজিট ভিসা নিয়ে যেসব বাংলাদেশি কাজের উদ্দেশ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাবেন, তারা বিএমইটি’র ছাড়পত্র নিয়ে যেতে পারবেন,” বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।

সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রবাসী বাংলাদেশিরা জরুরি প্রয়োজনে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের শর্তে দেশে আসতে পারবেন। প্রত্যেক যাত্রীকে কোভিড নেগেটিভ সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলকভাবে প্রদর্শন করতে হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনসমূহ দেশে ফিরতে ইচ্ছুক প্রবাসী কর্মীদের তালিকা প্রস্তুত করবে।

“বিদেশ থেকে ফেরত যাত্রীদের ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোরেনটাইন নিশ্চিতের জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ দিয়াবাড়ি, চট্টগ্রাম ও সিলেটে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে। পাঁচ দেশ থেকে যেসব যাত্রী দেশে আসবেন, তারা বোর্ডিংয়ের পূর্বেই কোয়ারান্টাইনের জন্য নির্দিষ্ট হোটেলে বুকিং নিশ্চিত করবেন,” বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছে। রেমিট্যান্সের কারণে করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বড় কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি।

সরকারি হিসাবে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কমপক্ষে ৩৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন, সৌদি আরবেই আছেন ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশি।

গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর–ডিসেম্বর) রেমিট্যান্স আয় এসেছে ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, যা গেল অর্থ বছরের একই প্রান্তিকের তুলনায় ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। অক্টোবর–ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে সৌদি আরব থেকে যা মোট রেমিট্যান্স আয়ের ২৩ দশমিক ৩২ শতাংশ।

বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট এক কোটি ২৩ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছেন।   

একদিনে প্রাণহানি ১০১

মার্চ থেকে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। প্রায় প্রতিদিনই আগের দিনের চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ এপ্রিল থেকে সাত দিনের কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার।

শুক্রবার এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘন্টায় দেশে ১০১ জন মানুষ করোনাভাইরাস সংক্রমণে মারা গেছেন এবং নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন চার হাজার ৪১৭ জন। প্রথমবারের মতো করোনায় মৃত্যু সংখ্যা একশ অতিক্রম করলো।

সব মিলিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়াল ১০ হাজার ১৮২ জন এবং এ পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাত লাখ ১১ হাজার ৭৭৯ জন।

শুক্রবার ছিল লকডাউনের তৃতীয় দিন। সাপ্তাহিক ছুটির কারণে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসমাগম ছিল কম। তবে মোড়ে মোড়ে পুলিশ পাহারা ছিল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।