জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট নকল করে গুজব ছড়ানোর হিড়িক
2018.11.19
ঢাকা
কাছাকাছি নামের ‘ডোমেইন’ (ঠিকানা) নিয়ে ওয়েবসাইট ‘ক্লোন’ (নকল) করে ভুয়া সংবাদ ছড়ানো নতুন কিছু নয়। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশে এর প্রকোপ হঠাৎ-ই বেড়ে গেছে, যার শিকার হয়েছে জনপ্রিয় বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলোর ‘ওয়েবসাইট’।
যেসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে, তার অধিকাংশই নির্বাচনমুখী, তথা রাজনৈতিক। বাংলাদেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার সোমবার বেনারকে বলেন, “খবরটি আমি জেনেছি। দুই-একটি নকল সাইটও দেখছি। এটি অবশ্যই এক ধরনের অপরাধ।”
মেধাস্বত্ব ও ডিজিটাল নিরাপত্তা, এই দুটি আইনের আওতায় এর প্রতিকার পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
ইতিমধ্যে নকল করা হয়েছে বিবিসি বাংলাসহ দৈনিক প্রথম আলো, যুগান্তর, বিডিনিউজ, বাংলাদেশ প্রতিদিনের ওয়েবসাইট। আক্রান্ত হয়েছে বাংলাভাষার প্রথম গুজব শনাক্তকারী সাইট বিডি ফ্যাক্ট চেক-ও।
তথ্য যাচাইকারী এই সাইটের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী জাহেদ আরমান বেনারকে বলেন, “হঠাৎ করেই গুজবের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ আসন্ন নির্বাচন। ভুয়া সংবাদ সৃষ্টিকারীরা সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে।”
শনিবার এক প্রতিবেদনে প্রথম আলো লিখেছে, “নকল ওয়েবসাইটটির ডোমেইনে নামের বানান প্রথম আলো সাইটের নামের বানানের থেকে আলাদা। তবে খুব কাছাকাছি। সেখানে ভুয়া তথ্য দিয়ে বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন প্রকাশ করে তা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করছে।”
একই মহল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রথম আলোর নামে পেজ তৈরি করেছে।
একইদিন বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে বলেছে, তাদের ওয়েবসাইট bbcbangla.com বা bbc.com/bengali, আর ভুয়া সাইটটির ঠিকানা রয়েছে bbc-bangla.com। একইভাবে প্রথম আলোর ওয়েবসাইট prothomalo.com হলেও, ভুয়া সাইটের ঠিকানায় একটি অতিরিক্ত ‘a’ যোগ করা হয়েছে, prothomaalo.com।
এ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের সাংবাদিক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলী আর রাজী বেনারকে বলেন, “পরিস্থিতি গুরুতর। আরও ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যে কোনো মুহূর্তে বড় বিপদের আশঙ্কা রয়েছে।”
“নকল সাইটগুলো একযোগে ‘কিছু একটা প্রচার’ করে নির্বাচনী সহিংসতা উসকে দিতে পারে। কোনো দল বা প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে যায় এমন ‘মিথ্যে প্রচারণা’ কারণ হতে পারে অরাজকর পরিস্থিতির,” যোগ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, “বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেললে অবশ্যই স্ব-উদ্যোগে ব্যবস্থা নেবে সরকার। তবে স্বপ্রণোদিত হয়ে কাউকে বিচার করার সুযোগ নেই।”
মন্ত্রীর অভিমত, যেসব সংবাদমাধ্যম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সরকারের উদ্যোগের অপেক্ষায় বসে না থেকে আদালতে যাওয়া উচিত।
“আদালত নির্দেশ দিলে আমরা (সরকার) ভুয়া সাইটগুলো বন্ধ করে দিতে পারি,” বলেন তিনি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সমাধান
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে শনিবার রাজধানীর তেজগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার কথা বলা হলে মন্ত্রী জানান, মেধাস্বত্ব বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আশ্রয় না নিলে সহজে প্রতিকার পাবেন না আক্রান্তরা।
জাতীয় সংসদের ভেতরে-বাইরে বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি, উদ্বেগ ও মতামত উপেক্ষা করে গত সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করার কথা উল্লেখ করে জব্বার বলেন, “আইনটি পাসের জন্য আমাকে গালাগালি করার সময় সাংবাদিকেরা টের পাননি যে এটা ছাড়া তারাও কতটা অসহায়।”
“এখন প্রতিকার পেতে তাদের ডিজিটাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের কাছেই আসতে হবে,” যোগ করেন মন্ত্রী।
কারণ হিসেবে তিনি জানান, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটের ডোমেইন মেধাস্বত্ব আইনে নিবন্ধিত নয়।
তবে আলী আর রাজীর অভিমত, গুজবের কারণে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সাধারণ মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। “এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে,” বেনারকে বলেন এই গণমাধ্যম বিশ্লেষক।
দুই কারণে ছড়ায় গুজব
জাহেদ আরমান বেনারকে বলেন, “ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক, সাধারণত এই দুই কারণে ভুয়া সংবাদ ছড়ানো হয়। গবেষণা মতে, নির্বাচনকে সামনে রেখে ছড়ানো গুজব ভোটারদের আচরণ পরিবর্তন করতে পারে, যা ভোটদানে প্রভাব বিস্তার করে।”
“আমাদের কাছে কিছু প্রমাণ আছে এগুলো কারা করছে। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে তা প্রকাশ করতে পারছি না,” বলেন বিডি ফ্যাক্ট চেক-এর এই প্রবাসী উদ্যোক্তা।
গুজব ঠেকানো অসম্ভব
জাহেদ আরমান জানান, কারিগরিভাবে ভুয়া সংবাদ ঠেকানোর জন্য ‘মেশিন লার্নিং’ এবং ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ এর কথা বলা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সফটওয়্যারও আছে। তবে এটা একেবারে ঠেকানো যাবে না।
“তা ছাড়া ওই সব কারিগরি উদ্যোগ ইংরেজি ভাষার কথা মাথায় রেখে নেওয়া হয়েছে। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এগুলো ঠিক কাজ করে না,” বলেন তিনি।
আরমান মনে করেন, “বাংলাদেশে ভুয়া সংবাদ ঠেকানোর জন্য মানুষের ‘মিডিয়া লিটারেসি’ (গণমাধ্যম জ্ঞান) বাড়াতে হবে।”
বিডি ফ্যাক্ট চেক এই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল থেকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্যাক্ট চেক যাত্রা শুরুর পর থেকে গতকাল পর্যন্ত তাদের সাইটে ১১৮টি গুজবের সত্যতা উন্মোচনে করা হয়েছে।
এ ছাড়া ফেসবুকের মাধ্যমে তারা আরও ২১টি ভুয়া সংবাদ শনাক্তের খবর দিয়েছে।