ভূমধ্যসাগরে ভাসতে থাকা ৬৪ জনের মধ্যে ১৭ জন ফিরলেন

জেসমিন পাপড়ি
2019.06.21
ঢাকা
190621_Mediterranea_returned17_1000.jpg হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের ফটকে তিউনিসিয়া থেকে ঢাকায় ফেরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিয়ামত শিকদারের ছবি দেখাচ্ছেন তাঁকে নিতে আসা দুই আত্মীয় মেহেদী হাসান (বামে) ও রবিন শিকদার (ডানে)। তাঁদের মোট পাঁচজন স্বজন ওই ভেসে থাকা নৌকাটিতে ছিলেন। ২১ জুন ২০১৯।
[শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]

অবৈধভাবে ইউরোপে যাত্রা করে নৌকা বিকল হয়ে তিন সপ্তাহ ধরে ভূমধ্যসাগরে ভেসে বেড়ানো ৬৪ বাংলাদেশির মধ্যে দেশে ফিরেছেন ১৭ জন। বাকিদেরও ক্রমান্বয়ে দেশে ফেরত পাঠানো হবে বলে বেনারকে জানিয়েছে লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস।

শুক্রবার বিকেল সোয়া ৫টায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি বিমানে এই ১৭ জন বাংলাদেশি তিউনিসিয়া থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউল হক।

তিনি জানান, বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

শুক্রবার মধ্যরাত সাড়ে ১২টার সময়েও জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। বিষয়টি নিশ্চিত করে ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরীফুল হাসান বেনারকে বলেন, তাঁদের ঠিকানা ভেরিভিকশনের জন্য সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে বার্তা প্রদান করেছে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। তাঁদের ‘অ্যারাইভাল’ হতে সময় লাগবে বলে জানিয়েছে ইমিগ্রেশন।”

এই নিয়ে গত একমাসে তিউনিসিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন ৩৯ জন বাংলাদেশি। এরা সবাইকে ইউরোপে যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করা হয়।

গত ১১ মে ভাসমান নৌকা থেকে উদ্ধার হওয়া ১৫ জন বাংলাদেশি দেশে ফেরেন ২১ মে। এর তিন দিন পরই দেশে ফেরেন ১০ মে রাতের নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া তিনজন। এছাড়া ১০ ও ১৯ জুন দুই দফায় দেশে ফিরেছেন ওই ঘটনার আরো চার সাক্ষী।

শুক্রবার দেশে ফেরা ১৭ জনের মধ্যে আটজন মাদারীপুর ও চারজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার। বাকিরা শরীয়তপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের বাসিন্দা।

উল্লেখ্য, গত ৩১ মে থেকে তিউনিসিয়ার জলসীমায় ভাসছিলেন ৬৪ বাংলাদেশিসহ ৭৫ জন অবৈধ অভিবাসী। নৌকাটি তিউনিসিয়ার উপকূলের কাছে পৌঁছালেও শরণার্থী কেন্দ্রে জায়গা না থাকার কারণে তাঁদের তীরে নামার অনুমতি দেয়নি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।

অন্যদিকে নৌকার যাত্রীরাও তীরে নামার বদলে তাঁদের ইউরোপে যেতে দেওয়ার দাবিতে অনশন করছিলেন। পরে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন।

লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, আটকে পড়া বাংলাদেশিরা দেশে ফিরে যাবেন, দূতাবাসের পক্ষ থেকে তিউনিসিয়া কর্তৃপক্ষকে এমন নিশ্চয়তা দেবার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাঁদেরকে ১৮ জুন সন্ধ্যায় জারজিস বন্দরে নামার অনুমতি দেয়।

“তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কোনক্রমেই তাঁদেরকে জারজিস বা মেডেনিনে থাকার অনুমতি প্রদান করেনি,” নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে টেলিফোনে বলেন দূতাবাসের এক কর্মকর্তা।

“এই অবস্থায় উদ্ধারকৃত বাংলাদেশিদের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তিউনিসে এনে রেড ক্রিসেন্ট ও আইওএম এর যৌথভাবে পরিচালিত শেল্টার হাউজে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে সবাইকে দেশে পাঠানো হচ্ছে,” বলেন তিনি।

ভূমধ্যসাগরে ১০ মে রাতের নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ১৪ জন বাংলাদেশির একজন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের মঞ্জুর আলম হিমেল (বামে) দেশে ফিরেছেন ১৯ জুন। ছবিটি ঢাকায় তাঁর এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তোলা। ২১ জুন ২০১৯।
ভূমধ্যসাগরে ১০ মে রাতের নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ১৪ জন বাংলাদেশির একজন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের মঞ্জুর আলম হিমেল (বামে) দেশে ফিরেছেন ১৯ জুন। ছবিটি ঢাকায় তাঁর এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তোলা। ২১ জুন ২০১৯।
[শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]

তিনজন ফিরতে নারাজ

দূতাবাস সূত্র জানায়, ওই ৬৪ জনের মধ্যে প্রথম দফায় ২০ জনকে টিকিট দিলেও তিনজন ফিরতে রাজি হননি।

লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, তিনজন দেশে আসতে রাজি না হওয়ার বিষয়টি নতুন দুশ্চিন্তার কারণ। একইভাবে শেল্টার হাউজে অবস্থানরত আরো কিছু বাংলাদেশি এই মুহূর্তে দেশে যেতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। বিষয়টি অত্যন্ত চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কেননা তাঁদের সবাইকে দেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে রাজি করানোর পরই তিউনিসিয়ার কর্তৃপক্ষের নিকট নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল।

দূতাবাসের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, কাপড় এবং তিউনিসে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে, জানান বাংলাদেশি কর্মকর্তারা। এছাড়াও তাঁদের সকলের আত্মীয়স্বজনের সাথে দেশে কথা বলার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এদিকে বুধবার দেশে ফেরা মঞ্জুর আলম হিমেল বেনারকে বলেন, “নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ১৪ বাংলাদেশির মধ্যে সাতজন এখনও তিউনিসিয়ায় আছেন। যাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনও পালিয়ে ইউরোপে ঢোকার কথা ভাবছে।”

বিশ্লেষকেরা বলছেন, একের পর এক এমন ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তাই যেকোনো মূল্যে এই ধরনের মানবপাচার বন্ধ করতে হবে।

“উদ্ধারকৃত সবাই দেশে ফিরে না গেলে বা আশ্রয় কেন্দ্র থেকে পালিয়ে গেলে পরবর্তীতে এই রকম দুর্ঘটনায় তিউনিসিয়া কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে,” বেনারকে বলেন ব্রাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরীফুল।

তিনি বলেন, “সম্প্রতি তিউনিসিয়ার সাগরে বেশ কিছু মানুষ মারা যাওয়ার পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালাল। তারপরেও একইভাবে ইউরোপে যাচ্ছে মানুষ। অর্থাৎ আমরা মানবপাচার বন্ধ করতে পারিনি।”

শরীফুল হাসান বলছিলেন, “দেশের বিশেষ কিছু জেলা থেকে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই জেলাগুলোতে কারা মানবপাচারের সাথে যুক্ত তা চিহ্নিত করে তাঁদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব না হলে মানবপাচার চলতেই থাকবে।”

“তাছাড়া মানুষের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, বিদেশ যাওয়া মানেই অনেক টাকা উপার্জন করা। মানুষের মধ্যে এমন মনস্তত্ব তৈরি হওয়ার পিছনে রাষ্ট্রই দায়ী। মানুষ যেমন বিদেশ যেতে চায়, রাষ্ট্রও চায় চলে যাক। মানবপাচার বন্ধের পাশাপাশি এই মনস্তত্ব আমাদেরকে ভাঙতে হবে,” বলেন তিনি।

শুক্রবার যারা ফিরেছেন

ফিরে আসা ১৭ জনের মধ্যে কয়েকজনের পরিচয় বেনারের হাতে এসেছে।

তাঁরা হলেন, মাদারীপুরের মোহাম্মদ লাদেম মাতুব্বর, রাসেল মাতুব্বর, রাজীব মাতুব্বর, জুয়েল সেজাল, আজাদ রহমান, পিয়ার আলী, আকমান মাতুব্বর, মীর আজিজুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবু বকর সিদ্দীক, সাজুল খাউদু, ইদ্রিস জমাদ্দার, নিয়ামত শিকদার, শরীয়তপুরের রাকিব হোসেন, মৌলভীবাজারের জিল্লুর রহমান, নোয়াখালীর রফিকুল ইসলাম, চাঁদপুরের শফিকুল ইসলাম ও সুনামগঞ্জের মো. শিপন আহমেদ।

বড় চিন্তা ঋণ পরিশোধ

মাদারীপুরের মোহাম্মদ লাদেম মাতুব্বরের বাবা লুৎফর মাতব্বর বেনারকে বলেন, “মাস পাঁচেক আগে আমার মেজ ছেলে লাদেম চার লাখ ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে কর্মসংস্থানের সন্ধানে লিবিয়া যায়। সেখানে কোনো কাজ পায়নি সে।”

“এদিকে ঋণ করে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে খানিকটা বিপদে পড়ে যাই। এরই মধ্যে লিবিয়ায় বুলেট নামে এক বাংলাদেশি দালালের সাথে পরিচয় হয় লাদেমের,” জানান তিনি।

লুৎফর মাতব্বর বলেন, “তিন লাখ টাকার বিনিময়ে সে আমার ছেলেকে ইতালি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে। অনেক কষ্টে আমি আরো তিনলাখ টাকা যোগাড় করে বুলেটের প্রতিনিধির হাতে তুলে দেই। পরে জানতে পারি আমার ছেলে সাগরে ভাসতেছে।”

“আজ ছেলে বেঁচে ফিরে ফিরেছে এতেই খুশি। তবে এখন বড় চিন্তা কীভাবে এই ঋণের টাকা শোধ করব,”হতাশ কণ্ঠে বলেন লাদেমের বাবা।

ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন শরীফ খিয়াম

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।