আশুরার তাজিয়া মিছিল প্রস্তুতির সময় বোমা হামলা: দুই জেএমবি সদস্যের কারাদণ্ড
2022.03.15
ঢাকা
পুরান ঢাকায় শিয়া সম্প্রদায়ের হোসেনি দালান ইমামবাড়া চত্বরে পবিত্র আশুরার তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় বোমা হামলা মামলার ছয় আসামিকে খালাস দিয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছেন, তদন্ত কর্মকর্তার খামখেয়ালীর কারণেই তাঁরা শারীরিক, আর্থিক এবং মানসিক কষ্টের শিকার হয়েছেন।
বিচারকের এই বক্তব্যের কথা জানিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ ম মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আদালত প্রকাশ্যেই বলেছে, শুধু আসামির সংখ্যা বাড়াতেই এই ছয়জনকে চার্জশিটভুক্ত করা হয়েছিল।”
“তদন্ত সংস্থার গাফিলতির কারণেই গত সাত বছর ধরে তাঁরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাই তদন্ত কর্মকর্তাকে তিরস্কার করেছে আদালত,” জানান ওই আইনজীবী।
মামলা থেকে এই ছয়জন খালাস পেলেও একই মামলায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা'আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) দুই সদস্যকে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর মহররমের রাত পৌনে ২টার দিকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে হোসেনি দালানের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে হ্যান্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটে।
এতে সাজ্জাদ হোসেন নামে এক কিশোর ঘটনাস্থলে নিহত এবং শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু আহত হন। পরে হাসপাতালে মারা যান জামাল উদ্দিন নামে আরেকজন।
ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান মঙ্গলবার এ রায় ঘোষণা করেন। আদালত চত্বরে ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌসুলি (পিপি) গোলাম ছারোয়ার খান জাকির সাংবাদিকদের বলেন, বিস্ফোরণে সম্পৃক্ততা থাকায় “দুই আসামি মোহাম্মদ আরমানকে ১০ বছর এবং কবির হোসাইনকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।”
এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে জানিয়ে আসামি পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, “শুধুমাত্র ১৬৪ ধারার জবানবন্দীর ওপর ভিত্তি করে তাঁদের যেভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে তা আইনসম্মত হয়নি বলে আমরা মনে করি। উচ্চ আদালতে আপিল করা হলে এই সাজার আদেশ টিকবে না।”
মামলায় খালাস পাওয়া অভিযুক্তরা হলেন; ওমর ফারুক মানিক, হাফেজ আহসান উল্লাহ মাহমুদ, শাহজালাল মিয়া, চান মিয়া, আবু সাঈদ রাসেল ওরফে সোলায়মান ওরফে সালমান ওরফে সায়মন ও রুবেল ইসলাম ওরফে সজীব ওরফে সুমন।
‘পুলিশ দায়িত্ব পালন করেনি’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ব্যারিস্টার আরাফাত হোসেন খান বেনারকে বলেন, “এই মামলার রায় পুলিশের ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ। এখানে পুলিশের যে দায়িত্ব ছিল, সেটা তারা পালন করেনি।
“এক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধে আদালত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলত তাহলে একটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হতো। তাঁদের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁরা চাইলে এখন ক্ষতিপূরণ নিতে পারেন হাইকোর্টের মাধ্যমে। এমন ক্ষতিপূরণ পাওয়ার নজিরও আছে।”
ফারুক আহম্মেদ জানান, “হামলার মূল পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা ও হামলাকারীরা আইনের আওতার বাইরে রয়ে গেছে,” উল্লেখ করে আদালত আরো বলেছে, পূর্ণ তদন্ত না করে মূল পরিকল্পনাকারী এবং নির্দেশদাতা আলবানী, নোমান এবং গ্রেনেড হামলাকারী হিরন ওরফে কামালকে মামলায় আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
অন্য দিকে “সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই” চাঁন মিয়া, ওমর ফারুক ওরফে মানিক, হাফেজ আহসান উল্লাহ মাহমুদ এবং শাহজালাল মিয়াকে মামলার আসামি হিসেবে সোপর্দ করা হয়েছে। “এতে করে তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. শফিউদ্দিন শেখ চরমভাবে দায়িত্বে অবহেলার পরিচয় দিয়েছেন,” বলেছে আদালত, জানান ফারুক আহম্মেদ।
মামলার নথিতে বলা হয়, ওই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন জেএমবির আলবানী ওরফে শাহাদত ওরফে মাহফুজ ওরফে হোজ্জা, আবদুল্লাহ বাকি ওরফে আলাউদ্দিন ওরফে নোমান, সাঈদ ওরফে হিরণ ওরফে কামাল। হামলার আগে ওই বছরের ১০ অক্টোবর তাঁরা বৈঠক করেছিলেন। পরে তাঁরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
ফারুক বলেন, তিনজনকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তারা কীভাবে কোথায় মারা গেলো, সে রেকর্ড চার্জশিটে নেই। এটা আনা উচিত ছিল।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “আমরা বহুদিন ধরেই বলে আসছি, জঙ্গি তৎপরতার সাথে যুক্ত উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ক্রসফায়ারে নিহত হচ্ছে অথবা ধরার সময়ই নিহত হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে মূল ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আদালতও আজকে প্রায় একই ধরনের অবজারভেশন দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিষয়টা স্পষ্ট হলো।”
“জঙ্গি হোক আর যা-ই হোক, বিচার পাওয়ার সে অধিকার রাখে। মানবাধিকারের দিক দিয়ে চিন্তা করলে, জঙ্গিরা যত নিকৃষ্ট অন্যায়ই করুক না কেন, বিচারের মাধ্যমে তাকে শাস্তি দিতে হবে। ক্রসফায়ার কাম্য না,” বলেন আরাফাত হোসেন খান।