নিউ ইয়র্কে বোমা হামলা: আকায়েদ উল্লাহর যাবজ্জীবন

জন বেকটেল
2021.04.22
ওয়াশিংটন ডিসি
নিউ ইয়র্কে বোমা হামলা: আকায়েদ উল্লাহর যাবজ্জীবন নিউ ইয়র্কের টাইম স্কয়ারের কাছে পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালে পুলিশ পাহারা। এই স্থানের কাছেই আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন আকায়েদ উল্লাহ। ১২ ডিসেম্বর ২০১৭।
[এপি]

যাবজ্জীবন সাজা পাবার আগ মুহূর্তে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে বোমা হামলাকারী বাংলাদেশি আকায়েদ উল্লাহ বৃহস্পতিবার আদালতকে জানিয়েছেন, তিনি যা করেছেন তা ভুল ছিল এবং সেজন্য তিনি অনুতপ্ত।

২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর সকালে নিউ ইয়র্কের টাইম স্কয়ারের কাছে পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালের পাতালপথে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন আকায়েদ (৩১)। এই বোমা হামলায় আকায়েদসহ মোট চারজন আহত হন।

বৃহস্পতিবার আদালতের রায় সরাসরি ফোন সংযোগের মাধ্যমে শোনার সুযোগ ছিল। তাতে শোনা যায়, আকায়েদ নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে বিচারককে বলছেন, “ডিসেম্বরের ১১ তারিখ আমি যা করেছি, তা ভুল ছিল।”

তিনি বলেন, “আমি অন্তর থেকে বলছি, আমি গভীরভাবে দুঃখিত।”

তবে সাজা ঘোষণার আগে আকায়েদের হামলাকে “সত্যিকার অর্থে বর্বরোচিত ও ভয়ানক অপরাধ,” বলে মন্তব্য করেন নিউ ইয়র্ক ফেডারেল আদালতের বিচারক রিচার্ড সুলিভান।

বৃহস্পতিবার আকায়েদের বিরুদ্ধে আনা মোট ছয়টি অভিযোগের সাজা ঘোষণা করে আদালত।

এতে তাঁকে তিনটি অপরাধে আলাদা আলাদা যাবজ্জীবন, একটি অপরাধে ৩০ বছর ও বাকি দুইটিতে ২০ বছর করে সাজা দেয়া হয়। সবগুলো সাজাই চলবে পাশাপাশি। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে যাবজ্জীবন আমৃত্যু সাজা। 

আকায়েদের বিরুদ্ধে আনা ছয়টি অভিযোগ হলো- সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে বাস্তবিকভাবে সহায়তা, জনসমাগম স্থলে বোমা বিস্ফোরণ, ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যে অস্ত্র ব্যবহার, বিস্ফোরক দিয়ে সম্পদ বিনষ্ট করা, গণ পরিবহন ব্যবস্থায় সন্ত্রাসী হামলার চেষ্টা এবং সন্ত্রাসমূলক অপরাধের উদ্দেশ্যে ধ্বংসাত্মক উপকরণ ব্যবহার। 

আকায়েদ উল্লাহ। [এপি]
আকায়েদ উল্লাহ। [এপি]
আইএস এর পক্ষে হামলা

গত ১ এপ্রিল প্রকাশিত সরকার পক্ষের আইনজীবীর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিউ ইয়র্কে বসবাসের সময় মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রচারমূলক ভিডিও দেখে আকায়েদ জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ওই সব ভিডিওতে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বিরুদ্ধে আক্রমণের আহ্বান জানানো হয়।

এতে বলা হয় আকায়েদের হামলার ঘটনার দুই সপ্তাহেরও কম সময় আগে আইএস ‘যুদ্ধের অগ্নিশিখা ২’ নামে একটি ভিডিও প্রচার করে তাদের সমর্থকদের যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলার আহ্বান জানায়।

ওই সময় আইএসের পক্ষে হামলা চালিয়ে আকায়েদ অন্যদের ধ্বংস করে নিজেও মরতে প্রস্তুত ছিলেন বলে জানানো হয় ওই সরকার পক্ষের আইনজীবীর ওই প্রতিবেদনে।

নিজের বোমায় আহত আকায়েদকে গ্রেপ্তারের পর চিকিৎসার জন্য স্থানীয় হাসপাতালে নেবার পর সেখানে তিনি হামলা সম্পর্কে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

তাঁর স্বীকারোক্তি প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক সাউদার্ন ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে তখন এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আকায়েদ তদন্তকারীদের বলেছেন, “আমি এটা ইসলামিক স্টেট এর জন্য করেছি।”

নিউইয়র্ক সাউদার্ন ডিসট্রিক্ট এর তখনকার ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল জুন কিম সাংবাদিকদের জানান, আকায়েদ ২০১৪ সালের দিকে আইসিসের (আইএস)  বিভিন্ন প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিয়ে এই আক্রমণ ঘটানোর কথা তদন্তকারীদের কাছে স্বীকার করেছেন।

ঘটনার এক বছর আগে থেকেই আকায়েদ বোমা বানানোর কৌশল সম্পর্কে গবেষণা করছিলেন জানিয়ে জুন কিম জানান, “সে হামলার জন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিকল্পনা করছিল। দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে থেকে বোমা তৈরির উপকরণ সংগ্রহ শুরু করে এবং আক্রমণের সপ্তাহখানেক আগে সে বোমাটি তৈরি করে।” 

আকায়েদ নিজের বাড়িতেই বোমাটি বানিয়েছেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানায় অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস। এছাড়া ওই বোমা বিস্ফোরণে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে আকায়েদের আত্মঘাতী হওয়ার পরিকল্পনা ছিল বলেও জানান জুন কিম।

নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে আকায়েদের বাসা তল্লাশি করে পুলিশ বোমায় ব্যবহৃত উপকরণের পাশাপাশি তাঁর পাসপোর্ট এবং তাঁর নিজের হাতে লেখা একটা নোটও উদ্ধার করে।

এতে লেখা ছিল “নিজের কৃতকর্মেই আমেরিকা ধ্বংস হবে” (অল আমেরিকা, ডাই ইন ইওর রেজ), বলেন কিম।

বোমা হামলার দিন ভোরবেলা আকায়েদ তাঁর ফেসবুকে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ্য করে “ট্রাম্প তুমি তোমার জাতিকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছ,” বলে এক পোস্ট প্রকাশ করেন বলেও জানানো হয় অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের বিজ্ঞপ্তিতে।

মামলার শুনানি শেষে ২০১৮ সালের নভেম্বরে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটান ফেডারেল আদালতে আকায়েদকে দোষী সাব্যস্ত করে।

যদিও সেসময় আকায়েদ সন্ত্রাসী নন এবং তাঁর হামলাটি “আত্মঘাতী বোমা হামলা নয়। সেটি সন্ত্রাসী আক্রমণও নয়,” বলে আদালতে দাবি করেন তাঁর আইনজীবী।

“সে মরতে চেয়েছিল। সে শুধুই তার নিজের জীবন ধ্বংস করতে চেয়েছিল,” আদালতে বলেন আকায়েদের আইনজীবী অ্যামি গ্যালিকিও।

হামলার আগে পর্যন্ত আকায়েদ শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করছিলেন জানিয়ে রায়ের আগে তাঁর সর্বোচ্চ ৩৫ বছর সাজাই উপযুক্ত বলে আদালতে দাবি করেছিলেন গ্যালিকিও।

যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম অনুযায়ী কোনো ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী না নির্দোষ তা প্রথমে সাব্যস্ত করা হয়। পরবর্তীতে অধিকতর যুক্তিতর্ক ও শুনানির পর সাজার ধরন ও মেয়াদ ঘোষণা করা হয়।

২০১৮ সালে দোষী সাব্যস্ত হবার পর আকায়েদের রায় ঘোষণা করা হলো বৃহস্পতিবার। 

বাংলাদেশে অপরাধে সম্পৃক্ততার প্রমাণ নেই

আকায়েদ উল্লাহর গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশের সন্দ্বীপে, তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার হাজারিবাগে।

ঢাকার জিগাতলার কাকলি স্কুল থেকে ২০০৪ সালে এসএসসি ও পরে মুন্সী আবদুর রউফ রাইফেলস কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন আকায়েদ। এর পর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএতে ভর্তি হন।

বিবিএ পড়ার মাঝখানে ২০১১ সালে তিনি সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্র চলে যান।

যুক্তরাষ্ট্রে যাবার আগে আকায়েদ “আর দশটা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মতোই ছিল,” বলে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।

বাংলাদেশে থাকার সময় তার কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলেও জানান তিনি। 

সর্বশেষ ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আকায়েদ বাংলাদেশে গিয়ে অক্টোবরে ফিরে আসেন। দেশে তাঁর স্ত্রী ও বর্তমানে তিন বছর বয়েসি একটি শিশু সন্তান রয়েছে।

নিউইয়র্কে আকায়েদ প্রথমে ট্যাক্সি চালাতেন ও পরে একটি কোম্পানির মেকানিক হিসেবে কাজ করতেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।