আবার আফগানিস্তান যাচ্ছে বাংলাদেশি জঙ্গিরা
2021.05.10
ঢাকা
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি জঙ্গিরা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত হবার জন্য পুনরায় দেশটিতে যাওয়া শুরু করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সম্প্রতি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমস ইউনিটের (সিটিটিসি) হাতে গ্রেপ্তার আফগানিস্তান ভিত্তিক আল-কায়েদার অনুসারী আনসার আল-ইসলামের চার সদস্য জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে তাঁদের কিছু সদস্য আফগানিস্তান চলে গেছেন। তা ছাড়া গ্রেপ্তার চারজনের কমপক্ষে দুইজন আফগানিস্তান যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
“আমরা গত শনিবার আনসার আল-ইসলামের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, তারা বাংলাদেশে পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যদের ওপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল,” সোমবার বেনারকে জানান সিটিটিসির উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম।
“আটক চারজনের মধ্যে দুইজন আমাদের জানিয়েছে, তারা আফগানিস্তানে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল,” জানিয়ে তিনি বলেন, “সেখান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর আনসার আল-ইসলামের সদস্যরা আফগানিস্তান যাওয়া শুরু করেছে।”
সাইফুল ইসলাম জানান, “তাদের দুই সদস্য মার্চের কোনো এক সময়ে চট্টগ্রাম দিয়ে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য হয়ে পাকিস্তান পার হয়ে আফগানিস্তান গেছে। তাদের নাম আব্দুর রাজ্জাক ও মো. শিব্বির।”
“মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশি জঙ্গিদের আফগানিস্তান যাওয়া একটি নতুন মাত্রা। আমরা এটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছি। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হয়েছে,” বলেন সাইফুল ইসলাম।
জঙ্গিরা অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করে বিস্ফোরক প্রস্তুতের চেষ্টা করেছিল বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, মে মাসে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে আনসার আল-ইসলাম ও নব্য জেএমবির কমপক্ষে ১২ সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের শুরু থেকে ২০০১ সালের শেষ দিকে মার্কিন অভিযানের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে অনেক জঙ্গিই আফগানিস্তান গেছে। আফগান ফেরত জঙ্গিরাই বাংলাদেশে ফিরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করে।
তবে, গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো সেনা উপস্থিতি থাকায় বাংলাদেশ থেকে জঙ্গিরা সেদেশে যায়নি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ফলে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণ করতে শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ থেকেই জঙ্গিরা আফগানিস্তান যাবে এবং এই অঞ্চলের দেশগুলোতে নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান রোববার সংবাদ সম্মেলনে জানান, শনিবার পুলিশের হাতে আটক মো. জসিমুল ইসলাম ওরফে জ্যাক, মো. আব্দুল মুকিত, মো. আমিনুল হক ও সজীব ইখতিয়ার প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আফগানিস্তানে যাওয়ার কথা জানায়।
জসিমুল হক বেসরকারি অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটির বিবিএ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, আব্দুল মুকিত হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানার মারকাজুস সুন্নাহ্ আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক, আমিনুল হক সিলেটের আল হিদায়া ইসলামিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র এবং সজীব ইখতিয়ার সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী।
রোববার তাঁদের আদালতে তোলা হলে বিচারক তাঁদের আরো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি
সোভিয়েত সরকারের সমর্থনে ১৯৮৬ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন মো. নজিবুল্লাহ। তাঁকে রক্ষার জন্য ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সেনা পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সকল পশ্চিমা শক্তির সমর্থনে এবং পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সারা বিশ্ব থেকে মুসলিম জঙ্গিরা সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। সেসময় বাংলাদেশ থেকে অনেক জঙ্গি সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে আফগানিস্তান যায়।
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী পরাজিত হয়ে সেদেশ ছাড়লে ১৯৯২ সালে নজিবুল্লাহকে পিটিয়ে হত্যা করে তালেবানরা। ১৯৯২ সালে তালেবানরা কাবুল দখল করে নেয়।
এরপর সেখান থেকে ফিরে আসে অনেক বাংলাদেশি আফগান যোদ্ধা। ১৯৯৪ সালে তারা জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রকাশে ঘোষণা দিয়ে হরকাতুল জিহাদ গঠন করে। ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ স্লোগান দিয়ে মিছিল করে তারা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ আফগানিস্তানে যুদ্ধে গেছে। তাদের অনেকে মারা গেছে। আবার অনেকে ফিরে এসেছে। তবে তাদের প্রকৃত সংখ্যা জানা নেই।”
“যারা ফিরে এসেছে তারাই এদেশে জঙ্গি গ্রুপ গঠন করেছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে সেখানে তালেবানের দুই গ্রুপ, দুর্বল আল-কায়েদা ও ক্রমবর্ধমান ইসলামিক স্টেট গ্রুপের সদস্যরা সক্রিয় হবে।”
তাঁর মতে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার বাংলাদেশের “নিরাপত্তার জন্য বেশ সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।”
“এই প্রত্যাহারের ফলে আমাদের স্থানীয় জঙ্গিদের একটি আশ্রয়স্থল তৈরি হলো। এদের মনোবল চাঙ্গা হবে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এ ছাড়া, বর্তমান মহামারির কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় অনেক যুবক জঙ্গিবাদের যুক্ত হয়ে আফগানিস্তানে যেতে পারে, যা দেশের জন্য বড় হুমকি।”
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহার “আমাদের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন আরেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার।
“সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পর ১৯৯৬ সালে জঙ্গিরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে এবং ২০০১ সালের শেষের দিকে মার্কিন বাহিনী কর্তৃক উৎখাতের আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল,” জানিয়ে তিনি বলেন, আফগানিস্তান থেকে থেকে এখন মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ফলে “খুব তাড়াতাড়ি তালেবান জঙ্গিরা কাবুল দখল করে নেবে বলে মনে হচ্ছে।”
“মার্কিন বাহিনীর অভিযানের আগ পর্যন্ত শত শত জঙ্গি বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্তানে গেছে। সেখান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে এসে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৯৮ সালে জেএমবি প্রতিষ্ঠার আগে আফগানিস্তান গিয়েছিল শায়খ আব্দুর রহমান,” বলেন মোহাম্মদ আলী শিকদার।
তিনি বলেন, “মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের জঙ্গিরা বিভিন্ন মাধ্যমে অস্ত্র ও টাকা পেয়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ পরিচালনা শুরু করবে। তারা বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্তান আসা-যাওয়া শুরু করবে।”
“ভারত ও বাংলাদেশে প্রায় একই রকমের সমস্যা; অনেক বড়ো সীমানা। এই বিরাট সীমানা দিয়ে তারা চলাচল করতে পারবে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “জঙ্গিদের এই সমস্যা মোকাবিলা করতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বিদ্যমান সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। ভারত-বাংলাদেশকে একসাথে কাজ করতে হবে।”