দিনাজপুরের তিন মসজিদ থেকে জঙ্গি সন্দেহে আটক ৬১
2021.09.17
ঢাকা
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদে জড়িত সংগঠন আল-কায়েদাপন্থী স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠী আনসার আল ইসলামের সদস্য সন্দেহে দিনাজপুরে ৬১ জনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
সিটিটিসি ইউনিটের স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ ও ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আব্দুল মান্নান শুক্রবার বেনারকে জানান, তিনটি মসজিদ থেকে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে আটক ওই সন্দেহভাজনেরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তাবলিগ জামাতে অংশ নেওয়ার ভান করে নাশকতার উদ্দেশ্যে সেখানে জড়ো হয়েছিলেন।
“যাচাই-বাছাই শেষে জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বলেন তিনি।
আটকরা সবাই দিনাজপুরের বাইরের বাসিন্দা বলে বেনারকে জানান দিনাজপুর প্রেসক্লাবে সহ-সভাপতি কঙ্কণ কর্মকার।
সম্প্রতি আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায় ও তালেবানদের সরকার গঠনের ঘটনা বাংলাদেশের কট্টর ইসলামি গোষ্ঠীগুলোকে নতুন করে উজ্জীবিত করেছে বলে মনে করেন অপরাধ বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক।
“ভূরাজনৈতিক কারণে দিনাজপুর ও ময়মনসিংহের মতো সীমান্তবর্তী জেলাগুলো এই জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ,” বলে মন্তব্য করে শুক্রবার তিনি বেনারকে বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ধরে ফেলতে পেরেছে, এটা অবশ্যই বড়ো সাফল্য।”
“কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে—একই মতাদর্শের অসংখ্য জঙ্গি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। তাদের সক্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে,” যোগ করেন টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক।
এদিকে “ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে আল-কায়দার কিছু রাজনৈতিক তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে,” বলে গত ১৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা ও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বার্ষিক সম্মেলনে জানান দেশটির সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) উপপরিচালক ডেভিড কোহেন।
“তবে আল-কায়দা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠবে, তা এখনই হিসাব করার সময় আসেনি,” কোহেনকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
তাবলিগের ছদ্মবেশে সক্রিয় জঙ্গিরা
দিনাজপুর জেলা পুলিশের সহায়তায় সিটিটিসি ইউনিট ওই ৬১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে “যাচাই-বাছাই শেষ না করে বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না,” বলে স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান দিনাজপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন।
জেলা শহরের পূর্ব উপকণ্ঠ মেদ্দাপাড়ার বায়তুল ফালা জামে মসজিদ থেকে ৩০ জন, বিরল উপজেলার বিরল বাজার জামে মসজিদ থেকে ১৭ জন এবং বোচাগঞ্জ উপজেলার আটগাঁও ইউনিয়নের বড়ুয়া গ্রাম জামে মসজিদ থেকে ১৪ জনকে আটক করা হয়।
“সিটিটিসি ইউনিটের কাছে তথ্য ছিল যে, জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করতে তাবলিগ জামাতের সদস্য হওয়ার ছদ্মবেশে তারা মসজিদে অবস্থান করছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা সেখানে একত্রিত হয়েছিল,” বেনারকে বলেন ডিসি মান্নান।
“এটা জঙ্গিদের একটা নতুন কৌশল হতে পারে। হয়তো তাবলিগ জামাতকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে তারা,” মনে করেন ড. উমর।
“সাধারণত তাবলিগ জামাতের সদস্যদের জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। যে কারণে তারা সন্দেহের আওতামুক্ত থাকে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “নির্বিঘ্নে সংগঠিত হতে এই সুযোগটির সদ্ব্যবহার করেছে জঙ্গিরা।”
তাঁর মতে, “আফগান পরিস্থিতির কারণে এই সময়ে তাদের (জঙ্গিদের) মধ্যে এক ধরনের উদ্দীপনামূলক মনোবৃত্তি কাজ করছে।”
বই ব্যবসার আড়ালে জঙ্গিবাদ প্রচার
বৃহস্পতিবার বিকেলে ময়মনসিংহ থেকে এবিটির দুই সক্রিয় সদস্যকে আটক করেছে পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। তাঁদের বিরুদ্ধে মুক্তাগাছা থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে শুক্রবার বেনারকে জানিয়েছেন এটিইউর পুলিশ সুপার (এসপি, মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান।
প্রসঙ্গত, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম বা সংক্ষেপে এবিটি আনসার আল ইসলামের পুরোনো নাম।
মুক্তাগাছা উপজেলার চেচুয়া বাজারে কালীবাড়ি মসজিদ এলাকা থেকে আটক দুই এবিটি সদস্যের নাম মো. কাওসার আহাম্মেদ ওরফে মিলন (৩০) এবং জাহিদ মোস্তফা (২০)।
“কাওসার নয় বছর ধরে এবিটির মতাদর্শ প্রচারকারী বই সংগ্রহ ও সরবরাহের কাজে জড়িত এবং জাহিদ দুই বছর ধরে তাকে সহযোগিতা করছে,” জানান এটিইউর এসপি আসলাম।
বেনারকে তিনি বলেন, “তারা চেচুয়া বাজারে বইয়ের দোকানের আড়ালে একাধিক ‘ফেইক ফেসবুক আইডি’ ব্যবহার করে দেশের এবিটি সদস্যদের কাছে উগ্র মতাদর্শের বই বিক্রি করে আসছিল।”
কারাবন্দি এবিটি প্রধান জসিম উদ্দিন রাহমানীসহ বিভিন্ন উগ্রপন্থী লেখকের সাতটি বইয়ের মুদ্রিত সংস্করণের পাশাপাশি সেগুলোর ‘সফট কপি’ তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছে এটিইউ।
বাংলাদেশে খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিহাদে উদ্বুদ্ধকরণ ভিডিও প্রচারসহ রাষ্ট্র বিরোধী বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে তাঁদের জড়িত থাকার প্রমাণও মিলেছে বলে জানিয়েছেন এসপি আসলাম।
বাংলাদেশে নিষিদ্ধ আল-কায়েদাপন্থীরা
সরকার ২০১৫ সালের মে মাসে আল-কায়েদাপন্থী এবিটি-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর সংগঠনটির সদস্যরা আনসার আল ইসলাম নামে তৎপর হয়। আনসার-আল-ইসলামকেও ২০১৭ সালের মার্চে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
সংগঠনটির প্রধান জসিম উদ্দিন রাহমানী ২০১৩ সালের আগস্টে বরগুনা থেকে আটক হওয়ার পর কারাগারে থাকলেও সেই বছর থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সংগঠিত কমপক্ষে নয়টি টার্গেট কিলিংয়ের সাথে তাঁর অনুসারীদের সংশ্লিষ্টতার খবর পাওয়া যায়।
আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার (একিউআইএস) পক্ষ থেকে এমন হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকারের ঘটনাও ঘটেছিল। এসব কর্মকাণ্ডের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে তখন থেকে আলোচনায় রয়েছে রাহমানীর সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধান (সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর) সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়ার (৪২) নাম।
গত আগস্টে এলজিবিটি অ্যাক্টিভিস্ট জুলহাজ মান্নান ও খন্দকার মাহবুব তনয় হত্যা মামলার রায় এবং গত ফেব্রুয়ারিতে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলা এবং প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার মামলার রায়েও মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত এই জঙ্গিকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ২০১৬ সালেই ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল পুলিশ।
“বর্তমানে জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া আরো পাঁচটি মামলার তদন্ত করছি আমরা। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে,” বেনারকে বলেন সিটিটিসি ইউনিটের তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তা মান্নান।