জঙ্গি সম্পৃক্ততা: লেকহেড স্কুলের মালিকসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তা আটক

জেসমিন পাপড়ি
2018.01.22
ঢাকা
ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় অবস্থিত লেকহেড গ্রামার স্কুল। ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় অবস্থিত লেকহেড গ্রামার স্কুল। ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর থেকেই একের পর এক নাটকীয় ঘটনার সৃষ্টি করছে লেকহেড গ্রামার স্কুল। আদালতের নির্দেশে স্কুলটি খুললেও একদিকে স্কুলটির মালিক; অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তাকে আটক করেছে পুলিশ, যারা শিক্ষামন্ত্রীর আস্থাভাজন বলে পরিচিত।

এদিকে দু্ই কর্মচারীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি আগে থেকে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়নি বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে তাঁদের আটক করা হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

এর আগে শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) মোতালেব হোসেন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গ্রহণ ও বিতরণ শাখার উচ্চমান সহকারী নাসির উদ্দিন নিখোঁজ হওয়ার পর রোববার তাঁদের আটকের কথা জানায় পুলিশ। তবে মোতালেব শনিবার বিকেলে থেকে ও নাসির বৃহস্পতিবার থেকে নিখোঁজ বলে পুলিশকে জানিয়েছিল তাঁদের পরিবার।

শনিবার থেকে নিখোঁজ লেকহেড স্কুলের মালিক খালেদ হাসান মতিনকে গুলশানে স্কুলটির সামনে থেকে তুলে নেওয়া হয় বলে স্থানীয় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। তবে রোববার রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে জানায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

আটকৃতদের বিষয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বেনারকে জানান, “লেকহেডের মালিককে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার ক‌রা হ‌য়ে‌ছে। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চমান সহকারী ও মন্ত্রীর পিও জঙ্গি সম্পৃক্ততায় বন্ধ হওয়া এই স্কুলটি চালু করে দেওয়ার নামে এর মালিকের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছিলেন।”

আটকের সময় নাসিরের কাছে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা পাওয়া গেছে বলেও জানান তিনি।

তবে গ্রেপ্তারের প্রায় ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁদের আদালতে তোলা হয়নি। মঙ্গলবার তাঁদের আদালতে তোলা হবে বলে জানিয়েছেন ডিবি কর্মকর্তারা।

এ প্রসঙ্গে আব্দুল বাতেন জানান, বেশ কিছু অভিযান নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তাঁদের আদালতে তোলা হয়নি। যদিও আটকৃতদের নিয়েই অভিযান চালানো হয়েছে কি না সে বিষয়টি পরিষ্কার করেননি তিনি।

“জঙ্গিবাদ সম্পৃক্ততায় বন্ধ হওয়া স্কুল খোলার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়া মানে পরোক্ষভাবে জঙ্গিবাদকেই উৎসাহিত করা। মন্ত্রণালয়গুলোতে ঘুষ এবং উৎকোচের বিনিময়ে এ ধরনের কাজ হতে পারে বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের,” বেনারকে বলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) এমন সাখাওয়াত হোসেন।

তবে এর মাঝে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সফলতাও দেখছেন তিনি।

ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত বলেন, “এ বিষয়গুলো সামনে আসার অর্থ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ইন্টেলিজেন্স ও অন্যান্য শাখাগুলো কাজ করছে। সেদিক থেকে তাঁদের সামর্থ্য যে বেড়েছে তা প্রমাণিত হয়।”

আটকদের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “পুলিশ ও ডিবি কাউকে ধরলে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই ধরে। এদের বিষয়ে তদন্ত শেষ হলে বোঝা যাবে তাঁরা কতটুকু দোষী কিংবা কোনো অপরাধ করেছে কি না।”

রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজার মণ্ডপ ঘুরে দেখার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।

আর আটক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুজনের বিরুদ্ধে চাকরিবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করেছে। তাঁরা যদি কোনো ধরনের অপরাধ করে থাকেন, ব্যবস্থা সরকার নেবে। আইনি ব্যবস্থায় যা আছে তাই হবে।”

নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, “আমরা কখনো কোনো অন্যায়কারী, কোনো ঘুষ খাওয়া, দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, বেআইনি কাজ করা কোনো লোককে প্রশ্রয় দেবো না, আমরা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।”

প্রসঙ্গত, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত লেকহেড গ্রামার স্কুলটির নাম আলোচনায় আসে ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর। এরপরেই দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত তিন জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে স্কুলের সাবেক অধ্যক্ষসহ কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তার যোগসূত্রের বিষয়টি নজরে আসে।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, স্কুলটির প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ জেনিফার আহমেদ ও গণিত শিক্ষক মনিরুজ্জামান মাসুদ ছিলেন হিযবুত তাহরীরের সদস্য। ২০০৯ সালে হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হওয়ার পর লন্ডন চলে যান জেনিফার আহমেদ।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে পুলিশের গুলিতে নিহত জঙ্গিগোষ্ঠী নব্য জেএমবির সামরিক প্রশিক্ষক সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলাম ছিলেন এই স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। এছাড়া শিক্ষক জুবাইদুর রহমানও নব্য জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

তদন্ত কর্মকর্তাদের সূত্রমতে, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইট উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যে গ্রেপ্তার ও পরবর্তীতে ৩০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত রাজীব করিমের ভাই তেহজিব করিম, তাঁর স্ত্রী সিরাত করিম এবং তাঁদের সহযোগী মাইনুদ্দিন শরীফ ও মাইনুদ্দিনের ভাই রেজওয়ান শরীফও ছিলেন এই স্কুলের শিক্ষক।

২০১০ সালে ইয়েমেনে আল-কায়েদা বিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হয়ে সেখানে আট মাস কারাভোগ করেন তেহজিব। মাইনুদ্দিন শরীফ ২০১৪ সালে আইএসএ যোগ দেয়ার জন্য পরিবারসহ সিরিয়ায় পাড়ি জমান বলে অভিযোগ রয়েছে। এরা দেশে জামায়াতে মুসলেমিনের সদস্য ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এছাড়া অপর শিক্ষক ওয়াদুদ জুম্মান ওরফে সাইফুল আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য ছিলেন বলে জানায় তদন্ত সূত্র।

প্রথম অধ্যক্ষ জেনিফার দেশ ছাড়ার পর লেকহেড গ্রামার স্কুলটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন হারুণ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের মালিক হারুন অর রশিদ ও তাঁর ছেলে রেজওয়ান হারুন।

লন্ডন থেকে ঢাকায় ফেরার পর গত বছরের ১১ মে থেকে নিখোঁজ রয়েছেন রেজওয়ান। এরপর জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৬ নভেম্বর স্কুলটি বন্ধের আদেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে দুটি রিট আবেদন করেন স্কুলটির মালিক ও ১২জন শিক্ষার্থীর অভিভাবক।

এসব রিটের শুনানি শেষে গত ১৪ নভেম্বর স্কুলটি খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।