রাজনৈতিক বিভাজনে বাংলাদেশে নতুন ধরনের জঙ্গিবাদ উত্থানের আশঙ্কা

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.02.28
ঢাকা
ঢাকার পশ্চিম নাখালপাড়ার একটি জঙ্গি আস্তানায় র‍্যাবের অভিযানে জেএমবির তিন সদস্য নিহত হয়। ঢাকার পশ্চিম নাখালপাড়ার একটি জঙ্গি আস্তানায় র‍্যাবের অভিযানে জেএমবির তিন সদস্য নিহত হয়। ১২ জানুয়ারি ২০১৮।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

বাংলাদেশে নতুন ধরনের জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে পারে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)। কারণ হিসেবে তারা আগামী নির্বাচনের আগে দেশের প্রধান দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক বিভাজন এবং আন্তর্জাতিক গ্রুপের সঙ্গে স্থানীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর সম্পৃক্ততাকে দায়ী করেছে।

নতুন ধরনের জঙ্গিবাদ বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা হুমকির মুখে ফেলতে পারে বলেও আশঙ্কা সংস্থাটির। তাদের মতে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ বাংলাদেশকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলেছে। কারণ রোহিঙ্গা মুসলিমদের দুঃখ-দুর্দশা পুঁজি করে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো।

“কাউন্টারিং জিহাদিস্ট মিলিট্যান্সি ইন বাংলাদেশ” শিরোনামে ব্রাসেলস থেকে বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেশের নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ পরোক্ষভাবে দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

এতে বলা হয়, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছর সাজা দেওয়া ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচার ও তাঁদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা প্রদানের ফলে দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা নষ্ট হয়েছে। উত্থান হয়েছে জিহাদি গ্রুপের।

এ প্রসঙ্গে কিছুটা একমত পোষণ করেন দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরাও।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “আমি ক্রাইসিস গ্রুপের মতো কঠোর মতামত দিতে চাই না। তবে এটা ঠিক যে, দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর না থাকলে জঙ্গিরা সেই সুযোগ নেবে।”

“জামায়াতে ইসলামী এখন গণতান্ত্রিক স্পেস পাচ্ছে না। তাঁদের জাতীয় নির্বাচনে শতকরা চার ভাগ ভোট রয়েছে। আগামী নির্বাচনে যদি অংশগ্রহণ করতে না পারে তাহলে তাঁরা মরণ কামড় দিতে পারে,” মনে করেন তিনি।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গিদের দাঁত ভেঙে দিয়েছে। আমরা তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছি। তারা আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না।”

তিনি বলেন, “আমাদের গোয়েন্দা বাহিনী তৎপর আছে, সজাগ আছে। এ দেশে জঙ্গিদের স্থান হবে না।”

জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের কারণ

আইসিজির দাবি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নেতাদের বিচার ‘ত্রুটিপূর্ণ ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়’ সম্পন্ন হয়েছে। এর জেরেই আনসার আল ইসলাম নামক জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইসলামিক স্টেটের আদর্শের অনুসারী জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও আল-কায়েদার মতবাদে বিশ্বাসী আনসার আল ইসলাম দেশের দুটি জঙ্গি গোষ্ঠী। যারা দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও ধর্মনিরপেক্ষ কর্মীদের হত্যা করেছে, আক্রমণ করেছে।

“বাংলাদেশের বিরোধপূর্ণ জাতীয় রাজনীতি জঙ্গিদের পুনরায় উত্থান ঘটাতে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে,” বলছে আইসিজির প্রতিবেদন।

এতে আরও বলা হয়, “যদিও বিষাক্ত রাজনীতির সঙ্গে জিহাদি সহিংসতার সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। তবে ধর্ম নিরপেক্ষ ও ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে মারাত্মকভাবে বিভক্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং নিষ্ঠুর ও দলীয়ভাবে দ্বিধা বিভক্ত পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থা জিহাদি গ্রুপদের উত্থানের সুযোগ করে দিয়েছে।”

গত কয়েক বছর জঙ্গিদের উত্থান ঠেকাতে রাষ্ট্র গুমসহ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্বিচার শক্তি প্রয়োগের আশ্রয় নিয়েছে। ফলে বড় সংখ্যক প্রাণ হারিয়েছে। জঙ্গিরা দুর্বল হয়ে পড়েছে।

নিরাপত্তা হুমকির কারণ রোহিঙ্গা

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে লাখ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থীর প্রবেশ বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। ইসলামিক স্টেট ও পাকিস্তানি জঙ্গিসহ অন্যান্য গোষ্ঠীরা রোহিঙ্গাদের দুর্দশাকে পুঁজি করে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে। তবে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়নি।

আইসিজি বলছে, বাংলাদেশের উচিত রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কাউন্টার টেররিজম বিষয়ে মনযোগ দেওয়ার পরিবর্তে রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য প্রদানের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের সঙ্গে শরণার্থীদের সম্ভাব্য সংঘর্ষ বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

সুশাসন নিশ্চিত করাই সমাধান

এমন অবস্থায় দেশে সুশাসন নিশ্চিতের বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন জামায়াতের প্রসঙ্গ টেনে আবারও বলেন, “যদি তাঁদের কর্মীদের শতকরা এক ভাগ আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায় তাহলে অবস্থা খুব খারাপ হবে। আর তখন হয়ত অবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”

“আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জঙ্গিদের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। কিন্তু এটা সাময়িক পরিত্রাণ। দেশে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা,” বলেন তিনি।

“আমরা ১৯৭২-৭৪ সালে বামপন্থীদের জঙ্গিবাদী তৎপরতা দেখেছি। আজও দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে সেই চরমপন্থা রয়েছে; নিঃশেষ হয়নি। তাই জঙ্গিরা যে শেষ হয়ে গেছে বা যাবে সে কথা বলা ঠিক হবে না।” বলেন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত।

সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তা বলেন, মানুষের প্রত্যাশা দেশের আগামী নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করুক, দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অটুট থাকুক।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমি বারবারই বলছি—যারা জেএমবি তারাই আনসার আল ইসলাম তারাই জামায়াত-শিবির। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নাম নিয়ে তাদের জঙ্গিবাদি কার্যক্রম চালিয়ে যায়।”

“আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হবে। আশা করি সব দল অংশগ্রহণ করবে। দেশে জঙ্গিবাদও মাথা চাড়া দেবে না,” বলেন মন্ত্রী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।