হাসনাত করিমকে মুক্তির আদেশ
2018.08.08
ঢাকা
দুই বছর আগে ঢাকায় সংঘটিত দেশের ইতিহাসে সবচে নৃশংস সন্ত্রাসী হলি আর্টিজান ক্যাফে হামলার চার্জশিট গ্রহণ করে বুধবার নিরপরাধ ও ‘অবস্থার শিকার’ হাসনাত করিমের মুক্তির আদেশ দিয়েছে ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী আদালত।
হাসনাত করিমের আইনজীবী সানোয়ার হোসেন সমাজদার বেনারকে জানিয়েছেন তাঁর মক্কেল সম্ভবত বৃহস্পতিবার কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন।
একই সাথে ওই মামলার পলাতক দুই আসামি ও নব্য জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আদেশ দিয়েছে বিচারক মুজিবুর রহমানের আদালত।
১৬ আগস্ট আদালত পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছে।
১৬ আগস্টের মধ্যে দুই পলাতক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা না গেলে ওই দিন তাদের আটকের অগ্রগতি সম্পর্কে আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করবে পুলিশ।
আদালত সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর হলি আর্টিজান হামলার চার্জশিট গ্রহণের তারিখ ধার্য করবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন ঢাকা কোর্টের আইনজীবী প্রকাশ বিশ্বাস।
তিনি বলেন, চার্জশিট গ্রহণ হলেই ২০১৬ সালের পয়লা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফে হামলা মামলার বিচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে।
সন্ত্রাস বিরোধী আদালতে বিশেষ প্রসিকিউটর মো. গোলাম সারোয়ার খান বেনারকে বলেন, আজ আদালত হলি আর্টিজান ক্যাফে হামলার ওপর পুলিশের দেওয়া চার্জশিট গ্রহণ করেছেন। চার্জশিটে হামলার জন্য মোট ২১ জন সন্ত্রাসীকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গত ২৩ জুলাই পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগ হলি আর্টিজান হামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করে বলে জানান ওই বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম।
চার্জশিট অনুসারে হামলার সাথে যুক্ত ২১ জন নব্য জেএমবি জঙ্গির মধ্যে ১৩ জন বিভিন্ন পুলিশি অপারেশনে মারা গেছেন। ছয়জন কারাগারে আর দুজন পলাতক রয়েছেন।
২০১৬ সালের ২ আগস্ট থেকে ওই হামলার সন্দেহভাজন হিসাবে কারাগারে আটক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসনাত করিমের কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি পুলিশ।
বুধবার কারাগারে আটক ছয় জঙ্গিসহ হাসনাত করিমকে হাতকড়া পরিয়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আদালতে আনা হয়। তাঁদের উপস্থিতিতেই বিচারক মুজিবুর রহমান চার্জশিট গ্রহণের সিদ্ধান্ত জানান।
বুধবার হাসনাত করিমের আইনজীবী সানোয়ার হোসেন সমাজদার বেনারকে বলেন, “আমি আজ আদালতে বলেছি, আমার মক্কেল বিনা অপরাধে গত দুই বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন। আবার পুলিশের চার্জশিটে উল্লেখ রয়েছে যে, এই ঘটনার সাথে হাসনাত করিমের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাই তাঁকে মুক্তির আদেশ দেওয়া হোক।”
তিনি বলেন, “আদালতে আমি আরও আরজি জানিয়েছি, তার ডিসচার্জ ওয়ারেন্ট (মুক্তির আদেশ) আজই যেন জেলগেটে পৌঁছায়। বিচারক আদালতকে জানিয়েছেন, আজকের মধ্যেই ডিসচার্জ ওয়ারেন্ট জেল গেটে পৌছাবে।”
সানোয়ার বলেন, “সম্ভবত হাসনাত করিম আজ মুক্তি পাচ্ছেন না। কারণ, মুক্তির কাগজপত্র ও আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে একদিন লেগে যায়। আশা করা যায় উনি আগামীকাল মুক্তি পাবেন।”
২০১৬ সালের পয়লা জুলাই রাতে ঢাকার গুলশান ৭৯ রোডে অবস্থিত হলি আর্টিজান ক্যাফে ও বেকারিতে অতর্কিত হামলা চালায় সশস্ত্র নব্য জেএমবির পাঁচ জঙ্গি। তারা সেখানকার সকল অতিথিদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে; যাদের মধ্যে অধিকাংশই বিদেশি।
জিম্মিদের আটকের ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যে প্রায় সকলকে হত্যা করে জঙ্গিরা। নিহতদের মধ্যে ১৭ জন ছিলেন বিদেশি। আর তিনজন বাংলাদেশি।
জিম্মি সংকটের মধ্যেই ইসলামিক স্টেটের মিডিয়ায় ২০ জনকে হত্যার খবর প্রচার করে তারা ঘটনার দায় স্বীকার করে। একইসাথে হামলাকারীদের ছবেও প্রকাশ করে তারা।
হামলার কিছু আগে হাসনাত করিম তার স্ত্রী শারমিনা পারভীন ও দুই মেয়েকে নিয়ে তাঁদের এক মেয়ের জন্মদিন পালন করতে হলি আর্টিজান ক্যাফেতে যান।
জিম্মি নাটকের অবসানের জন্য পরদিন সকালে পরিচালিত সামরিক কমান্ডো অপারেশনের কিছুক্ষণ আগে জঙ্গিরা হাসনাত করিম ও তার পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে দেয়।
তদন্তে হাসনাত করিমকে ‘অবস্থার শিকার’ হিসাবে উল্লেখ করা হয় বলে জানিয়েছেন হাসনাতের আইনজীবী সমাজদার।
তবে পুলিশের তদন্তে ওই হামলায় বিদেশি কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা পায়নি পুলিশ।
ওই অপারেশনে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। নিহত পাঁচ হামলাকারী হলো, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ।
দুই পুলিশ অফিসারসহ সব মিলিয়ে ওই ঘটনায় মোট ২৯ জন নিহত হন।
হাসনাত করিমের স্ত্রী শারমিনা পারভীন বুধবার বেনারকে বলেন, “আমরা জেনেছি যে আদালত তাকে মুক্তি দিতে বলেছে। বুঝতেই পারছেন আমাদের অবস্থা। আমরা অবশ্যই খুশি। দেখা যাক কখন তিনি মুক্ত হন।”
তিনি বলেন, হাসনাত করিমের শ্বশুর তাঁকে গ্রহণ করতে কাশিমপুর কারাগারে যাবেন।
জীবিত অভিযুক্ত জঙ্গি
সন্ত্রাস বিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় যে আটজনকে আসামি করা হয়েছে, তাঁরা হলেন, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদীসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, মামুনুর রশিদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদ।
আসামি আটজনের ছয়জন কারাগারে আছে। পলাতক রয়েছে রিপন ও খালিদ।
তদন্তে এই হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরী। তিনি ঘটনার দুই মাস পর নারায়ণগঞ্জের একটি বাড়িতে দুই সহযোগীসহ পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
২৩ জুলাই মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, নিহত ১৩ জন বিচার প্রক্রিয়া থেকে বাদ যাবে। তবে জীবিত আটজনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
আইনজীবী প্রকাশ বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসের নৃশংসতম সন্ত্রাসী হামলার বিচার দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করা দরকার। অন্যথায় সন্ত্রাসীদের বিচারে আমাদের আন্তরিকতা ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।”