অবশেষে মুক্ত হাসনাত করিম
2018.08.09
ঢাকা
বিনা অপরাধে দুই বছরের বেশি সময় কারাগারে আটক থাকার পর বৃহস্পতিবার মুক্তি পেয়েছেন হলি আর্টিজান সন্ত্রাসী হামলার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম।
তাঁর স্ত্রী শারমিনা পারভীন বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, বিকেল চারটার পরে হাসনাত করিম কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
তিনি বলেন, তাঁর বাবা (হাসনাত করিমের শ্বশুর) কারাগার ফটকে উপস্থিত থেকে রাতে তাঁকে গুলশানের বাসায় নিয়ে আসেন।
হাসনাত করিম অথবা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য কারা ফটকে সাংবাদিকদের সাথে কথা না বলে গাড়িতে উঠে পড়েন।
বুধবার গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফেতে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার চার্জশিট গ্রহণ করে হাসনাত করিমকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে নির্দেশ দেয় ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী আদালত। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে হাসনাত করিম ও অন্যান্য জঙ্গিদের আদালতে উপস্থাপন করা হয়।
দুই বছর ধরে করা তদন্তে পুলিশ হলি আর্টিজান হামলার সাথে হাসনাত করিমের কোনো রকম সংশ্লিষ্টতা পায়নি বলে আদালতে জানানো হয়। পুলিশের ওই তদন্তে হাসনাত করিমকে মুক্তি দেওয়ার আবেদন জানানো হয়।
২৩ জুলাই হলি আর্টিজান হামলার প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয় পুলিশ।
হাসনাত করিমের আইনজীবী সানোয়ার হোসেন সমাজদার বেনারকে বলেন, আদালত বুধবারের মধ্যেই তাঁর মক্কেলের মুক্তির আদেশ কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, একজন বন্দীর মুক্তির জন্য অনেক আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে যেগুলো শেষ করতে বৃহস্পতিবার পুরো দিন লেগে যায়।
শারমিনা পারভিন বলেন, “এটাই বলতে পারি আমরা খুশি। সে আমাদের কাছে ফিরেছে। আপনারা যারা আমাদের জন্য লিখেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ।”
নিরাপরাধ হাসনাত করিমের মুক্তি বিলম্ব হওয়া সম্পর্কে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, বিনা বিচারে কোনো ব্যক্তিকে বা কোনো নিরাপরাধ মানুষকে আটকে রাখা ‘সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য ও ‘চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন’।
তিনি বলেন. “রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের মানবাধিকার রক্ষা করতে বাধ্য। কিন্তু তার পরিবর্তে আমার দেখছি, কোনো অপরাধ না করে হাসনাত করিমের মতো অথবা বিনা বিচারে অনেকেই কারাগারে জীবন কাটাচ্ছে।”
ড. মিজানুর রহমান বলেন, “চার্জশিটে তিনি অভিযুক্ত নন বিষয়টি জানার পরই আদালত তাঁকে মুক্তি দিলে ভালো হতো।”
হাসনাত করিম কেন গ্রেপ্তার?
২০১৬ সালের পয়লা জুলাই রাতে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে হলি আর্টিজান ক্যাফেতে যান হাসনাত করিম। তারা খাবার অর্ডার দেওয়ার মধ্যেই অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইসলামিক স্টেটের আদর্শে বিশ্বাসী জঙ্গি সংগঠন নব্য জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর পাঁচ সন্ত্রাসী সেখানে উপস্থিত সকল খদ্দেরকে জিম্মি করে।
তারা বেছে বেছে বিদেশি নাগরিকদের প্রথমে গুলি করে পরে কুপিয়ে হত্যা করে। জিম্মি করার ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যে তারা প্রায় সবাইকে হত্যা করে বলে ২৩ জুলাই বেনারকে জানান কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।
ক্যাফের ভেতরে নয় ইতালিয়ান, সাত জাপানি, এক ভারতীয় এবং তিন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করে জঙ্গিরা।
পরদিন ২ জুলাই সকালে কমান্ডো অভিযানে নিহত হওয়ার আগে জঙ্গিরা হাসনাত করিম, তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়েকে ছেড়ে দেয়।
জিম্মি সংকটের অবসান হওয়ার আগে রাতেই আইএস মিডিয়ায় ২০ জনের মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়। একই সাথে হামলাকারীদের পরিচয় প্রকাশ করে হামলার দায় স্বীকার করে আইএস।
হাসনাত করিমের মোবাইল ফোন থেকে নিহতদের রক্তাক্ত ছবি ক্যাফের ভেতর থেকে পাঠানো হয় বলে মিডিয়ায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে পুলিশ ২ আগস্ট হাসনাত করিমকে আটক করে।
আদালত তাঁর জামিন প্রত্যাখ্যান করে কারাগারে প্রেরণ করে। এরপর থেকে তিনি কারাগারে ছিলেন।
তবে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে আক্রমণ চালানোর পর জঙ্গিরা হাসনাতের ফোন নিয়ে নেয় এবং একটি অ্যাপ ডাউনলোড করে ওই সকল নৃশংস ছবি আরেক জঙ্গি নুরুল ইসলাম মারজানের কাছে পাঠায়।
এরপর সেই ছবি আইএস মিডিয়াতে পাঠানো হয় বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
সরকার বরাবার বাংলাদেশে আইএস’র উপস্থিতি অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, হামলাকারী সংগঠন দেশীয় জঙ্গি নব্য জেএমবি। পুলিশের তদন্তেও হলি আর্টিজান হামলার সাথে কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের কোনো সংশ্লিষ্টতা পায়নি।
পুলিশের তদন্তে হাসনাত করিমকে ‘অবস্থার শিকার’ বলে উল্লেখ করা হয়।
চার্জশিটে মোট ২১ জন জঙ্গিকে হলি আর্টিজান হামলার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ১৩ জন বিভিন্ন সময় পুলিশ-র্যাবের অভিযানে নিহত হয়েছে। আটজন জীবিত রয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন আসামি পলাতক।
আগামী ১৬ আগস্ট আদালত ওই দুই পলাতক আসামি গ্রেপ্তারের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে এই মামলার চার্জ গঠন করবে বলে জানান ঢাকা কোর্টের আইনজীবী প্রকাশ বিশ্বাস।
তিনি বলেন, “চার্জ গঠন হলেই বিচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে বলা যাবে। যত দ্রুত সম্ভব এই মামলার বিচার শুরু করতে হবে। সারা বিশ্ব আমাদের দিকে চেয়ে আছে এই হামলার বিচারের দিকে। তাদের সকলকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।”
যে পাঁচ হামলাকারী সন্ত্রাসী হামলা চালায় তারা হলো, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ।
দুই পুলিশ অফিসারসহ সব মিলিয়ে ওই ঘটনায় মোট ২৯ জন নিহত হয়।
জীবিত অভিযুক্ত জঙ্গি
চার্জশিট অনুযায়ী, সন্ত্রাস বিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তাঁরা হলো, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদীসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, মামুনুর রশিদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদ।
রিপন ও খালিদ পলাতক।
তদন্তে এই হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরী যিনি হামলার দুই মাস পর নারায়ণগঞ্জের একটি বাড়িতে দুই সহযোগীসহ পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।