বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ: চার বাংলাদেশিসহ ১৯ জনের কারাদণ্ড
2019.08.30
কলকাতা
ভারতে ইসলামী সন্ত্রাসবাদ বিস্তারে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ মামলায় চার বাংলাদেশিসহ ১৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির একটি আদালত।
শুক্রবার কলকাতায় বিশেষ এনআইএ আদালতের রুদ্ধদ্বার কক্ষে (ইন ক্যামেরা) শুনানি শেষে বিচারক সিদ্ধার্থ কাঞ্জিলাল দোষীদের সাজা ঘোষণা করেন। বিচার চলাকালীন ১৯ জন আসামি দোষ স্বীকার করার তিন দিনের মধ্যেই এই রায় এলো।
গত বুধবার ১৯ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত। সকলের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতা, রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র, প্রতারণা ও বিস্ফোরক আইনের বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ আনা হয়। বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে ফরেনার্স আইনেও মামলা হয়।
ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনআইএ) আইনজীবী শ্যামল ঘোষ বেনারকে বলেন, “সর্বোচ্চ ১০ বছর এবং সর্বনিম্ন ৬ বছরের কারাবাসের সাজা ঘোষণা করেছেন বিচারক।”
অভিযুক্তদের আইনজীবী ফজলে আহমেদ আদালতের বাইরে বেনারকে বলেন, “আদালতের রায়ে আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি। দোষী ১৯ জনই পরিবার ও সন্তান-সন্ততির কথা উল্লেখ করে সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে চায় জানিয়ে সর্বনিম্ন সাজার আর্জি জানায়।”
কারাবাস শেষে দেশে ফেরত বাংলাদেশিদের
আইনজীবী ফজলে আহমেদ জানান, রায়ে আদালত কারাবাসের মেয়াদ শেষে চার বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে।
তিনি বলেন, “বিচারক বাংলাদেশের নাগরিকদের সর্বোচ্চ ১০ বছর এবং অন্যান্যদের ৮ থেকে ৬ বছরের কারাবাসের সাজা ঘোষণা করেন। সঙ্গে সকলকেই ২০ হাজার রুপি জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাবাসের রায় দেন।”
বর্তমান কারাবাসের সঙ্গেই কারাবাসের সাজা চলবে বলে জানান আসামিপক্ষের এই আইনজীবী।
সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে চারজন বাংলাদেশি নাগরিক। এরা হলেন, শেখ রহমতুল্লা ওরফে বুরহান শেখ, সাদিক ওরফে তরিকুল ইসলাম, লিয়াকত আলী প্রামাণিক ওরফে মহম্মদ রুবেল এবং হবিবুর রহমান ওরফে জহিদুল ইসলাম।
বাকি ভারতীয়রা হলেন, গুলসোনা বিবি ওরফে রাজিয়া বিবি, আলিমা বিবি ওরফে আমিনা বিবি, আব্দুল হাকিম, আমজাদ আলী শেখ, মহম্মদ শাহনুর আলম, সইফুল ইসলাম খান, মহম্মদ রেজাউল করিম, হবিবুর রহমান ওরফে নুর আলম, গিয়াসুদ্দিন মুন্সী, মোফাজ্জল আলি ওরফে লাদেন, আব্দুল কালাম, লাল মহম্মদ, আব্দুল ওয়াহাব মোমিন, মহম্মদ শহীদুল ইসলাম ও নুরুল হক মণ্ডল।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণ
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমানের খাগড়াগড়ের একটি দোতলা বাড়িতে গোপনে বোমা তৈরির সময়ে আচমকাই বিস্ফোরণ ঘটে। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবরের সেই বিস্ফোরণে দুই জেএমবি জঙ্গি শাকিল গাজী ও করিম শেখ নিহত হন। আহত হন আরো একজন।
তখন ঘটনাস্থল থেকে দুই শিশুসহ গুলসোনা বিবি এবং আলিমা বিবিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তদন্তে বেরিয়ে আসে বিস্ফোরণে নিহত দুজনই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির সদস্য।
এনআইএ তদন্তের দায়িত্ব নেবার পর প্রথম জানতে পারে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জামাআতুল মুজাহিদীন (জেএমবি) ভারতের তিন রাজ্যে কীভাবে নেটওয়ার্ক তৈরি করে জিহাদি কার্যক্রম চালাচ্ছিল।
আদালতে পেশ করা এনআইএ’র অভিযোগপত্রে বলা হয়, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সূত্রেই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনটির ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়। জেএমবি প্রথমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ঝাড়খণ্ডে ঘাঁটি তৈরি করে এবং পরে তা অন্য আরও কয়েকটি রাজ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল।
নথিতে আরও বলা হয়, পরিকল্পনা মাফিক ও অত্যন্ত সংগঠিতভাবে কিছু যুবককে সংগঠনে নিয়োগ করে তাদের জিহাদি কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করতে মগজধোলাই এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল জেএমবি।
এনআইয়ের আইনজীবী শ্যামল ঘোষ বলেন, “জঙ্গিদের বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল সন্ত্রাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করা এবং সেখানে শরিয়তি শাসন চালু করা।”
১৯ জনের দোষ স্বীকার
খাগড়াগড় বিস্ফোরণ মামলায় অভিযুক্ত ৩৩ জনের মধ্যে ৩০ জন বর্তমানে ভারতের কারাগারে এবং একজন বাংলাদেশের কারাগারে রয়েছেন। তবে অভিযুক্ত শীর্ষ জেএমবি নেতা সালাউদ্দিন আজও অধরা।
অভিযুক্তদের মধ্যে ১১ জনই বাংলাদেশের নাগরিক। এনআইয়ের মতে, তাঁদের অনেকেই জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতা।
বর্তমানে এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া চলছে।
বিচার চলাকালীনই ১৯ জন অভিযুক্ত বিচারকের কাছে দোষ স্বীকার করার আবেদন জানান বলে বেনারকে বলেন অভিযুক্তদের আইনজীবী ফজলে আহমেদ।
তিনি বলেন, “আবেদনে অভিযুক্তরা শাস্তির মেয়াদ শেষে পারিবারিক জীবনে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন।”
“এই আবেদনের শুনানিতে বিচারক প্রত্যেকের কাছেই জানতে চান, তাঁরা কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দোষ স্বীকার করছেন কিনা। সকলেই ‘না’ বলেন,” বলেন ফজলে আহমেদ।
এই আইনজীবী জানান, আদালতে অভিযুক্তদের হয়ে তাঁরা সর্বনিম্ন সাজার আবেদন করেন। তবে সরকারি আইনজীবী সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করেন।
এনআইয়ের আইনজীবী শ্যামল ঘোষ বলেন, “গত ২৮ আগস্ট অভিযুক্তদের অপরাধ স্বীকারের আবেদন গ্রহণ করে বিচারক ১৯ অভিযুক্তকেই দোষী সাব্যস্ত করেন। শুক্রবার সাজা ঘোষণা করা হয়।”
বাকিদের বিরুদ্ধে বিচার চলবে বলে জানান তিনি।
পশ্চিমবঙ্গকে করিডর হিসেবে ব্যবহার
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ বেনারকে বলেন, “খাগড়াগড় বিস্ফোরণকে স্থানিক ঘটনা ভাবলে ভুল হবে। এর আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি রয়েছে।”
“সীমান্তের দুপারের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতির মিল এবং অরক্ষিত সীমান্তের সুবিধা নিয়ে জঙ্গিরা পশ্চিমবঙ্গকে করিডর হিসেবে ব্যবহার করে তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে সক্রিয় রয়েছে।”
খাগড়াগড় বিস্ফোরণের ঘটনা জঙ্গি গোষ্ঠীর তৎপরতাকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে।”
তিনি মনে করেন, “পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় জেএমবিকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো যেভাবে তৎপর রয়েছে, তাদের উৎখাত করতে না পারলে আতঙ্ক থেকেই যাবে। এ ব্যাপারে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।”