দিনে আদালতের কর্মচারী, রাতে জঙ্গি কার্যক্রম
2019.11.20
ঢাকা
দিনের বেলায় এক নামে আদালতের কর্মচারী আর সন্ধ্যায় আরেক নামে জঙ্গি কার্যক্রমের প্রচার। এভাবে বেশ কয়েক বছর লুকোচুরি করে শেষ রক্ষা হয়নি। ওই জঙ্গিকে ধরা পড়তে হয়েছে এলিট ফোর্স র্যাবের হাতে।
গ্রেপ্তার হওয়া ওই ব্যক্তির প্রকৃত নাম আল আমিন পান্না। তিনি ঢাকা মহানগর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে কম্পিউটার অপারেটর কাম স্টেনোগ্রাফার পদে কর্মরত। তাঁর সাংগঠনিক নাম বাপ্পি।
র্যাব-১০ এর অধিনায়ক ও অতিরিক্ত ডিআইজি মো. কাইয়ুমুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “সাত মাস অনুসরণ করার পর গত ১৮ নভেম্বর পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকা থেকে র্যাব-১০ এর একটি দল আল আমিন পান্নাকে গ্রেপ্তার করে। মঙ্গলবার তাঁকে আদালতে পাঠানো হলে তাঁর জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে প্রেরণ করেন বিচারক।”
আদালত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের বিভিন্ন পেশার মানুষের জঙ্গিবাদের সাথে যুক্ত হওয়ার উদাহরণ থাকলেও বিচার বিভাগের কোনো কর্মীর চরমপন্থা অথবা জঙ্গিবাদের সাথে যুক্ত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম।
আল আমিন পান্না হিযবুত তাহরীরের সমর্থক। নিরাপত্তার জন্য হুমকি বিবেচনায় ২০০৯ সালে সরকার এই সংগঠনটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
মো. কাইয়ুমুজ্জামান খান বলেন, “গ্রেপ্তারের পর আমরা জানতে পারি পান্না ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কম্পিউটার অপারেটর কাম স্টেনোগ্রাফার। তাঁর আসল নাম আল আমিন পান্না। বাপ্পি তার সাংগঠনিক নাম।”
“আমরা তাঁকে গত সাত মাস ধরে আমাদের নেটওয়ার্কের মধ্যে অনুসরণ করে আসছিলাম। কিন্তু তাঁকে ধরা যাচ্ছিল না। কারণ, তাঁর নাম–ঠিকানা ভিন্ন,” জানান তিনি।
র্যাবের অধিনায়ক বলেন, “আল আমিন দিনে আদালতে কাজ করত। আর রাতে জঙ্গিবাদী প্রচারণায় লিপ্ত থাকত। তার ব্যাপারে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে সে কীভাবে, কার সহযোগিতায় জঙ্গিবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করত সে ব্যাপারে আদালতে প্রতিবেদন দেয়া হবে।”
ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও ঢাকা জেলা আদালতে আইন পেশায় জড়িত ও ঢাকা বারের সদস্য প্রকাশ বিশ্বাস আদালতে জমা দেয়া নথিকে উদ্ধৃত করে বেনারকে বলেন, “আল-আমিন পান্না হিজবুত তাহরীরের পক্ষে যে লিফলেট প্রচার করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছে সেখানে বলা ছিল ‘বাবরি মসজিদের সম্মান রক্ষার্থে হিন্দুত্ববাদী নতজানু এই সরকারকে উৎখাত করুন’।”
‘আদালতের গোপনীয়তা কোথায়!’
“খবরটি সাংঘাতিক রকমের দুঃসংবাদ,” মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ বেনারকে বলেন, “আদালতের কোনো কর্মকর্তা অথবা কর্মচারী দেশের ইতিহাসে কোনো দিন জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে যুক্ত হয়নি। এ ধরনের ঘটনা এটিই প্রথম।”
তিনি বলেন, “রাষ্ট্রের তিনটি অবিচ্ছেদ্য অংশের একটি হলো বিচার বিভাগ। যত ছোটই হোক না কেন সেখানকার একজন স্টাফ জঙ্গি হয়ে যাবে সেটি আমাদের জন্য অশনিসংকেত।”
ব্যারিস্টার শফিক বলেন, “আমাদের দেশে বিচারকদের সবাই কম্পিউটারে পারদর্শী নন। তাঁরা রায় থেকে শুরু করে সকল ধরনের গোপন নথি হাতে লিখে তা কম্পিউটার অপারেটর বা স্টেনোগ্রাফারদের দেন টাইপ করতে, এ জন্য তারা আমাদের বিচার ব্যবস্থার অন্যতম অংশ।”
“এখন তাদের কেউ কেউ যদি জঙ্গিদের সাথে হাত মেলায় তাহলে আদালতের গোপনীয়তা কোথায়! এই অভিযুক্ত কর্মচারী নিঃসন্দেহে আদালত থেকে গোপনীয় তথ্য জঙ্গিদের সরবরাহ করেছে। তাহলে আদালতের ওপর মানুষের আস্থা উঠে যাবে,” যোগ করেন তিনি।
ব্যারিস্টার শফিক বলেন, “বিষয়টি নিয়ে বিশদ তদন্ত প্রয়োজন। জানতে হবে সে যোগদানের সময় জঙ্গিবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল কিনা। অথবা দেখতে হবে, সে চাকুরিতে প্রবেশের পর জঙ্গিবাদী কার্যক্রমরে সাথে যুক্ত হয়েছে কি না।”
তিনি বলেন, “সে একাই যে জঙ্গি কার্যক্রমের সাথে যুক্ত সেটিও ভাবা ঠিক হবে না। তার সাথে আরও লোকজন আছে বলে আমার মনে হয়। একটি ভালো তদন্তকারীর মাধ্যমে এব্যাপারে বিশদ তদন্ত প্রয়োজন।”
শফিক আহমদ বলেন, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করতে হবে। অন্যথায় আমাদের জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে।”
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বেনারকে বলেন, “আসলে হিযবুত তাহরীরের কৌশল হলো বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের লোকদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে সুবিধামতো সময়ে তারা তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা।”
তিনি বলেন, “হয়তো সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে তারা আদালতে তাদের লোক তৈরি করেছে।”
আব্দুর রশীদ বলেন, “হিযবুত তাহরীর পোস্টার সেঁটে, লিফলেট বিতরণ করে এবং চলন্ত যানবাহনে হঠাৎ বক্তৃতা দিয়ে তাদের কার্যক্রমের বিস্তার ঘটানোর কাজে নিয়োজিত। তারা কোনো সহিংস কার্যক্রমে যায়নি।”
তিনি বলেন, “তবে হলি আর্টিজান হামলার পর সরকার জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রতি কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পর হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করে।”
“তবে তাই বলে তো তাদের লোকেরা বসে নেই। তারা চুপ মেরে ছিল। এখন আবার তারা তাদের কার্যক্রম বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে,” যোগ করেন মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ।