ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হত্যা ও নির্যাতন বাড়ছে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.12.30
জাতীয় হিন্দু মহাজোট আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন। জাতীয় হিন্দু মহাজোট আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন। ডিসেম্বর ৩০, ২০১৬।
বেনার নিউজ

ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৯৮জন নাগরিক বিদায়ী বছর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আহতের সংখ্যা ৩৫৭। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে বছর শেষ হওয়ার একদিন আগে এই তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট।

মহাজোটের নেতারা বলছেন, নির্যাতনের কারণে বহু হিন্দু পরিবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে, গত ১০ বছরে মোট ৯ লাখ হিন্দু কমেছে।

ওই নেতাদের মতে, হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাওয়ার বড় কারণ এই নির্যাতন। হত্যা ও নির্যাতন ঠেকাতে তাঁরা সরকার ও প্রশাসনের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।

হিন্দু মহাজোটের কাছে বিদায়ী বছরের হিসাব থাকলেও তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নামে সংখ্যালঘুদের আরেকটি সংগঠনের হিসেবে, দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসের তুলনায় ২০১৬ সালের প্রথম তিন মাসে নির্যাতনের ঘটনা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে বলে ঐক্য পরিষদ হিসাব দেয়।

গত এপ্রিলে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জানিয়েছিল, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ—এই তিন মাসে ৮২৫০টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে৷ এর মধ্যে হত্যা, অপহরণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর, গণধর্ষণ, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছেদের ঘটনাও রয়েছে৷

ঐক্য পরিষদ সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ২৬১টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ তাতে ১৫৬২টি প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ কিন্তু ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত প্রথম তিন মাসে সংখ্যালঘুদের ওপর কমপক্ষে ৭৩২টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে, যা আগের বছরের ঘটনার প্রায় তিনগুণ৷ এতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৫৬৬টি, যা আগের এক বছরের তুলনায় ছয়গুণেরও বেশি৷ এ সময়ে ১০ জন নিহত, ৩৬৬ জন আহত এবং ১০ জন হিন্দু অপহৃত হন।

এদিকে ২০১৬ সালে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার চিত্র তুলে ধরতে গতকাল শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে জাতীয় হিন্দু মহাজোট। তাঁরা ভবিষ্যতে সংখ্যালঘুদের পূর্ণ নিরাপত্তার দাবি জানান।

“২০১৬ সাল ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের বছর,” সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে জানান সংগঠনটির মহাসচিব আনন্দ কুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, প্রশাসনের সামনেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়।

হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ঘর-বাড়ি, মঠ-মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর, মন্দিরের রথের জায়গা দখলের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, “কাউকে খুশি বা অখুশি করার জন্য এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়নি। জাতির সামনে আমরা প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে চেয়েছি।”

সংবাদ সম্মেলনে ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরা হয়। এ সময়ে হতাহতের ঘটনা ছাড়াও ১১০৯ জন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে, ১৮ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া আটজনকে কারাগারে আটক করা হয়। মোট ৯৯ জন চাঁদাবাজি, মারধর বা নির্যাতনের শিকার হন।

প্রতিবেদনে লুটের ঘটনা ১৬৫টি বলে উল্লেখ করা হয়। নিখোঁজ হয় ২২ জন, ১৩টি বসতঘর ও দুইটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ২১০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, ১৪১টি মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়াও ২৬ জন ধর্ষণ ও চারজন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন, ১১ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।

সংগঠনটির নির্বাহী সভাপতি সুকৃতি কুমার মণ্ডল বেনারকে বলেন, এ বছর থেকে হিন্দু মহাজোট মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তুলনামূলক তথ্য না থাকলেও যে কোনো সচেতন মানুষ বলবেন যে, হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে।

এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০০১ ও ২০১১ সালের তথ্য তুলনা করলে দেখা যায়, হিন্দু জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে৷ বিশেষ করে ১৫টি জেলায় কমার সংখ্যাটা চোখে লাগার মতো। এসব জেলার মধ্যে রয়েছে; বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ ও পাবনা।

বিবিএস এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২ ভাগ ছিল হিন্দু৷ ২০১১ সালে তা হয় ৮ দশমিক ৫ শতাংশ৷

অবশ্য ২০১৫ সালের হিসেবে হিন্দু জনসংখ্যা বাড়ছে বলে জানায় বিবিএস৷ তাতে বলা হয়, মোট জনসংখ্যার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ হিন্দু৷ আর আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৪ সালে তা ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ৷

মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বেনারকে বলেন, “পরিচিত অনেক হিন্দু পরিবারই দেশ ত্যাগ করেছে৷ অনেক শহর ও গ্রাম ফাঁকা হয়ে গেছে৷ তারা প্রধানত নিরাপত্তার কারণেই বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷” তাঁর মতে, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নির্যাতন এবং তাঁদের বাড়িঘর দখলে দল–মত নির্বিশেষে একরকম ঐক্য দেখা যায় কোনও কোনও এলাকায়।

জাতীয় হিন্দু মহাজোটের নির্বাহী মহাসচিব পলাশ কান্তি দে বেনারকে বলেন, সরকার ও প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে এভাবে হিন্দুদের সংখ্যা কমত না, বা সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হতো না। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যাতে কোনো ধরনের নির্যাতনের ঘটনা না ঘটে সে জন্য সরকার ও প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।