অবশেষে মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.09.03
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
160903_BD_execution_1000.jpg পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনেরা মৃত্যুদণ্ড কাযর্কর করার আগে কারাগারে যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর সঙ্গে শেষ দেখা করেন। সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৬।
এএফপি

আইনের লড়াই শেষ হওয়ার পর আনুষাঙ্গিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা না চাওয়ার সিদ্ধান্ত জানানোর পর গতকাল শনিবার সরকারের ​আদেশে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।

৬৩ বছর বয়সী মীর কাসেম আলী ষষ্ঠ ব্যক্তি, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এই ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনই জামায়াতের শীর্ষ নেতা ও একজন বিএনপির নেতা।

এই প্রথম কাশিমপুর কারাগারে প্রথম কোনো যুদ্ধাপারাধীর ফাঁসি হলো। এর আগে পাঁচজনের ফাঁসি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হয়েছিল।

“রাত ১০ টা ৩০ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরপর লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন করা হয়েছে,” সাংবাদিকদের জানান জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক।

পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, মীর কাসেমের দাফন হবে মানিকগঞ্জে, যেটি তাঁর জন্মস্থান।

ফাঁসি কার্যকরের প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামী সোমবার সকাল ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত হরতাল ডেকেছে। এ ছাড়া রোববার দোয়া–দিবসের কর্মসূচি দিয়েছে দলটি।

মীর কাসেম আলীর মরদেহ নেওয়ার জন্য কারাগারে অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করে। ছবি: ফোকাস বাংলা।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁকে জামায়াতের অন্যতম অর্থ জোগানদাতা হিসেবে মনে করা হয়। তিনি কেয়ারি গ্রুপের মালিক।

এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা, দিগন্ত মিডিয়াসহ বেশ কিছু ব্যবসায়িক উদ্যোগের উদ্যোক্তা ও অংশীদার। তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হাসপাতাল, ভবন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, পরিবহন, গণমাধ্যমসহ অনেক কিছুই রয়েছে।

ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের নেতারা মীর কাসেম আলীর বিপুল ধন–সম্পদ বাজেয়প্ত করার দাবি জানিয়েছেন।

“একাত্তরের ওই ঘাতকের অবৈধ সম্পদ বাজেয়প্ত করে জনকল্যানে ব্যয় করা উচিত,” বেনারকে জানান চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নাসিরউদ্দিন আহমেদ।

একাত্তরে চট্টগ্রামেই মানবতাবিরোধী অসংখ্য অপরাধ করেন মীর কাসেম। চট্টগ্রামের সেসব এলাকায় গতকাল রাতে স্বস্তি নেমে আসে।

এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ফাঁসি ঠেকাতে মীর কাসেম কোটি কোটি টাকা খরচ করেছেন।

২০১২ সালের ১৭ জুন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর থেকেই কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন মীর কাসেম। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুটি অভিযোগে মীর কাসেমের ফাঁসি ও আটটি অভিযোগে কারাদণ্ড হয়। এরপরে তাঁকে কারাগারের কনডেমন সেলে স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকেই তাঁকে ফাঁসি দিতে নেওয়া হয়।

পরিবারের সঙ্গে শেষ দেখা

মীর কাসেমের সঙ্গে ‘শেষবার’ দেখা করতে বিকেলে কাশিমপুর কারাগারে স্বজনদের ঢুকতে দেয় কর্তৃপক্ষ। প্রায় তিন ঘণ্টা সাক্ষাতের পর কারাগারের বাইরে এসে খন্দকার আয়েশা খাতুন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।

“যারা ফাঁসি দিচ্ছে তাঁরা জয়ী হবে না। এই মৃত্যু ইসলামের জন্য মৃত্যু। এই মৃত্যু শহীদের শামিল,” জানান আয়েশা খাতুন।

গতকাল সকালে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁর পরিবারকে দেখা করার জন্য বেলা সাড়ে তিনটার জন্য আসতে বলে। বেলা ৩টা ৪০ মিনিটে ছয়টি গাড়িতে আসা পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাতের জন্য কারাগারে ঢোকেন। কারাগারের একটি সূত্র জানায়, ছয়টি গাড়িতে ৪২ জন সাক্ষাতের জন্য এসেছিলেন। ভেতরে ঢুকে আনুষ্ঠানিকতা সারার পরে তাঁরা সোয়া চারটায় মীর কাসেমের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। সাক্ষাৎ শেষে পৌনে সাতটার দিকে তারা কারাগার থেকে বেরিয়ে যান।

কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় মীর কাসেমের স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, “মীর কাসেম মৃত্যুভয়ে ভীত নন। তবে তিনি আক্ষেপ করেছেন যে ছেলেটার সঙ্গে তাঁর দেখা হলো না।”

গত ৬ আগস্ট তাঁর ছেলে ব্যারিস্টার আহম্মেদ বিন কাসেমকে বাসা থেকে কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছে, যিনি তার বাবা মীর কাসেমের একজন আইনজীবী।

এর আগে ৩১ আগস্ট স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুনের মাধ্যমে মীর কাসেম গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, নিখোঁজ ছেলেকে ফিরে পেলে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করেই প্রাণভিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। গত শুক্রবার তিনি প্রাণভিক্ষা না চাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন।

দিনভর ফাঁসির প্রস্তুতি

গতকাল সকাল থেকেই কাশিমপুর কারাগার এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। কোনাবাড়ী থেকে ঢোকার মুখে রাস্তার দুপাশের সব দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাস্তাটিতে যান চলাচলও নিয়ন্ত্রিত করা হয়। সন্ধ্যার পরে ভিড় করা আশপাশের বাসিন্দা উৎসুক মানুষকেও রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

জেলা পুলিশের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক র‍্যাব, ডিবিসহ গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ঘটনাস্থলের আশপাশের মোতায়েন ছিলেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে কারাগারে ঢোকেন আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইফতেখার উদ্দীন।

“দুপুরের পরে ফাঁসি কার্যকরের সরকারের নির্বাহী আদেশ কারাগারে পৌঁছায়,” বেনারকে জানান কাশিমপুর কারাগার-২-এর কারাধ্যক্ষ (জেলার) নাশির আহমেদ।

যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড

২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুটি অভিযোগে তাঁকে ফাঁসির আদেশ ও আটটি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

আপিল বিভাগের রায়ে ১১ নম্বর অভিযোগে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। এই অভিযোগের বর্ণনা অনুসারে, ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যেকোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়।

২৮ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁকে সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলেও আরও পাঁচজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির লাশসহ তাঁর মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

দণ্ড পাওয়ার পরে ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর আপিল করেন তিনি।

চলতি বছরের ৮ মার্চ আপিলের রায়ে ১৯৭১ সালে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে হত্যার দায়ে মীর কাসেমের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। অন্য ছয়টি অভিযোগে তাঁর বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড বহাল রাখেন আদালত।

যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী। ফাইল ফটো।

আপিল বিচারের পূর্ণাঙ্গ রায় গত ৬ জুন প্রকাশিত হয়। রায় বিবেচনা চেয়ে ১৯ জুন আবেদন করেন মীর কাসেম। এরপর গত ৩০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন। মীর কাসেমের আইনি লড়াইয়ে এই রিভিউ আবেদনই ছিল শেষ ধাপ। এরপর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের সুযোগ থাকলেও তিনি তা নেননি।

এর আগের যত ফাঁসি

মানবতাবিরোধী অপরাধের ২৬টি মামলায় ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল ও রিভিউ নিষ্পত্তির পর পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

তাঁরা হলেন; জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা­ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী।

এর বাইরে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিলের ওপর রায় হয়েছে, ট্রাইব্যুনালে তাঁকে দেওয়া সর্বোচ্চ সাজা কমিয়ে আপিল বিভাগ আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। এই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে দুই পক্ষ আবেদন করেছে। এ ছাড়া আপিল শুনানির অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় মারা যান গোলাম আযম ও মো. আবদুল আলীম।

প্রসিকিউটরদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে এখন ১৬টি আপিল রয়েছে। এর বাইরে আরও ২০টি মামলা ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ

“বিশ্বে গণহত্যার বিচারে এটা একটা মাইলফলক। গোটা জাতি স্বস্তি প্রকাশ করেছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল নব্বইয়ের দশকে তার একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হচ্ছে,” বেনারকে জানান একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবীর।

এদিকে মীর কাসেমের দণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে একটা যুগের অবসান ঘটতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।

“নানারকম লবিং-তদবির করে, অঢেল টাকা ছিটিয়ে মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছা ও নাগরিক আন্দোলনের ফলে সেই অপচেষ্টা সফল হয়নি,” বেনারকে জানান ইমরান এইচ সরকার।

তিনি বলেন, “আমরা মনে করি, এই রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে একটা যুগের অবসান ঘটতে যাচ্ছে, যে যুগটি ছিল সেই যুদ্ধাপরাধী যারা একদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে অপরদিকে স্বাধীনতার পরে তারাই আবার এই যুদ্ধাপরাধী সংগঠন নতুনভাবে সংগঠিত করেছিল এই বাংলাদেশে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।