মিয়ানমারে জান্তা উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালাবে বিদ্রোহী জোট
2024.10.30
সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরুর এক বছর পর মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে অভিযানের নেতৃত্বদানকারী জাতিগত বিদ্রোহী জোট বলেছে, সামরিক শাসক উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত তারা থামবে না।
অক্টোবরের ২৭ তারিখে আক্রমণের মাধ্যমে শুরুর কারণে “অপারেশন ১০২৭” নামে পরিচিত এই সশস্ত্র সংগ্রামে জাতিগত ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ উত্তর-পূর্ব মিয়ানমারের সাথে চীন সীমান্তবর্তী শান রাজ্যের বেশ কয়েকটি অঞ্চল সেনাবাহিনীর হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে গণঅসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এরপর তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি এবং আরাকান আর্মির সমন্বয়ে গঠিত তিনটি জাতিগত যোদ্ধাদলের জোট ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে।
তাদের ভাষায় আক্রমণের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে জান্তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা, মানুষের জীবন রক্ষা করা, আরও অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নেয়া, জান্তা বাহিনীর গোলন্দাজ এবং বিমান হামলা প্রতিরোধ করা এবং অনলাইন জালিয়াতি গ্যাং দমন করা।
সোমবার টিএনএলএ’র মুখপাত্র লওয়ে ইয়া ওও বেনারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আরএফএ বার্মিজকে বলেছেন, মিয়ানমারের সামরিক সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত অভিযান চলবে। একে অভিযানের "প্রথম অগ্রাধিকার" অভিহিত করেন তিনি।
"আমরা ২০২৫ সালে জনগণের সাথে একত্রে একটি অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকার গঠনের চেষ্টা করছি," যোগ করেন সংগঠনের এই নেত্রী।
চীনের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স তাদের অপারেশন ১০২৭-এর প্রথম দফায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪-এর জানুয়ারি মধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের মোট ১৬ টি শহর দখল করে নেয়।
জুনের শেষ দিকে জোটটি দ্বিতীয় দফা আক্রমণ শুরু করে লাশিও নগরী দখল করে, যেখানে জান্তার উত্তর-পূর্ব সামরিক কমান্ডের সদর দপ্তর ছিল। একই সাথে কিয়াউকম শহর যেখানে জান্তার ১ নং মিলিটারি অপারেশন কমান্ডের ঘাঁটি ছিল এবং নাউনঘকিও শহর ও পার্শ্ববর্তী মান্দালয় অঞ্চলের মোগোকে শহর দখল করে।
লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা
জোটের সদস্যদের সাথে থেকে লড়াই করা অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরএফএকে বলেছে, অপারেশন ১০২৭ তাদের সৈন্যদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা। এই গোষ্ঠীগুলো তাদের নিজস্ব এলাকায় জান্তার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
আক্রমণের সময় আরাকান আর্মির (এএ) সাথে যুক্ত থাকা ‘জেনারেশন জি’ আর্মির প্রধান অধিনায়ক অং কিয়াও মিও থান্ট বেনারকে বলেছেন, "শত্রুকে পরাস্ত করার জন্য আমাদের সক্ষমতা কতটা বাড়াতে হবে এবং কীভাবে আমাদের বাহিনী তৈরি করা উচিত সে সম্পর্কে আমরা জ্ঞান অর্জন করেছি।"
“অতীতে আমরা আমাদের এলাকায় কার্যকরভাবে লড়াই করতে পারিনি,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এখন এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাদেরকে কীভাবে আরও অঞ্চল দখল করা যায় সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে।"
উত্তর শান রাজ্যে লড়াই বেইজিংকে অস্থির করেছে এবং তারা আগস্টে মিয়ানমারের সাথে তাদের সীমান্তে চতুর্থ সামরিক মহড়া শুরু করেছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে জান্তার সাথে শত্রুতা বন্ধ করারও আহ্বান জানিয়েছে চীন।
চীনের চাপ এই অঞ্চলে উত্তেজনাকে শীতল করলেও রাজনৈতিক ভাষ্যকার থান সো নাইং মনে করেন লড়াই অব্যাহত থাকবে।
আরএফএকে তিনি বলেছেন "দেশের অন্যান্য অঞ্চলে অন্যান্য বিদ্রোহীদের অভিযান অব্যাহত আছে।" মিয়ানমারের রাজধানী শহরে জান্তার ক্ষমতার ঘাঁটিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, "এই সমস্ত অভিযানের লক্ষ্য নেপিডো।"
সীমান্তে চীনের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ
অপারেশন ১০২৭-এর বার্ষিকীতে অধিবাসীরা জানিয়েছেন, জান্তার সাথে যুদ্ধবিরতিতে যেতে বিদ্রোহীদের চাপে ফেলতে চীন তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয় এবং পণ্য প্রবেশের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। ফলে উত্তর শান রাজ্য এবং প্রতিবেশী কাচিন রাজ্যে জ্বালানী এবং খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
চীন গত ২২ অক্টোবর থেকে কিয়ালগাউং গেট দিয়ে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, নির্মাণ সামগ্রী এবং মোবাইল ফোন পরিবহন নিষিদ্ধ করেছে। ফলে শান রাজ্যের মিউজ শহর থেকে চীনের ডিহং দাই এবং ইউনান প্রদেশের জিংপো স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই অঞ্চলে পরিষেবা প্রদানকারী আরেকটি গেট জুলাই মাসে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
অপারেশন ১০২৭ শুরুর পর থেকে জান্তা সরকার মিয়ানমারের প্রাণকেন্দ্র থেকে উত্তর শান রাজ্যের শহরগুলোতে জ্বালানী, চাল, খাদ্য এবং ওষুধ পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে, যা বাসিন্দাদের চীন থেকে সরবরাহের উপর নির্ভর করতে বাধ্য করেছে। বাসিন্দারা বলেছেন, সাম্প্রতিক সীমান্ত বিধিনিষেধের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
“নামহ্কাম এলাকার কিছু দোকান পেট্রল এবং ডিজেল বিক্রি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে,” নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরএফএকে বলেছেন একজন বাসিন্দা।
“আগে মানুষ মোটরসাইকেলে যাতায়াত করলেও এখন অনেককে বাধ্য হয়ে হাঁটতে হচ্ছে। চীন যদি তেল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখে তাহলে ভবিষ্যতে মিউজ এবং নামহ্কাম সম্পূর্ণভাবে জ্বালানিহীন হতে পারে।”
বাসিন্দারা বলেছেন, নামহকামের পাঁচটি গ্যাস স্টেশনের মধ্যে মাত্র দুটি খোলা রয়েছে। মিউজ, মংকো এবং পাংসাংয়ের পার্শ্ববর্তী জনপদগুলিও জ্বালানী ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে। যার ফলে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে।
পরিবহন সমস্যা ও মূল্য বৃদ্ধি
মিউজের একটি সাহায্য সংস্থার একজন কর্মকর্তা আরএফএকে বলেছেন, সরবরাহ ঘাটতি এই অঞ্চলে মারাত্মক কষ্টের কারণ হয়েছে।
"এই সমস্যা কীভাবে সমাধান করবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন অনেকেই। কিছু পেট্রোল স্টেশন সম্পূর্ণভাবে বিক্রয় বন্ধ করে দিয়েছে," নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। “নিষেধাজ্ঞার পর থেকে দামও বেড়েছে; প্রতি লিটারে ৪৫০০ কিয়াট (বাংলাদেশি ১২০ টাকা) থেকে বেড়ে প্রতি লিটারে ৯,০০০ কিয়াট (বাংলাদেশি ২৪০ টাকা) হয়েছে। যারা পেট্রলের ওপর নির্ভর করে তাদের জন্য এই পরিস্থিতি কঠিন।”
অন্যান্য কিছু সূত্র আরএফএকে জানিয়েছে, সংস্কার এবং পরিদর্শন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য চীন কর্তৃপক্ষ ১৯ অক্টোবর মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যের সঙ্গেও বেশ কয়েকটি সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বাসিন্দারা পরিবহন সমস্যার কারণে খাদ্য সংকট ও মূল্য বৃদ্ধির সম্মুখীন হচ্ছেন।
মন্তব্যের জন্য আরএফএ মিয়ানমারে চীনা দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করলেও উত্তর পাওয়া যায়নি। একইভাবে জান্তার মুখপাত্র মেজর জেনারেল জাও মিন হুতুনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।