মিয়ানমারে জান্তা বাহিনীর বিমান হামলায় ৪১ রোহিঙ্গা নিহত
2025.01.09
মিয়ানমার বিমান বাহিনী রাখাইনের একটি জেলে পাড়ায় বোমা বর্ষণ করে ৪১ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। এতে আহত হয়েছেন আরো ৫২ জন। হতাহতদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা মুসলিম বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন উদ্ধার কাজে নিয়োজিত বাসিন্দারা।
বিদ্রোহীরা এই হামলাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে অভিহিত করেছে। বুধবার বিকেলে সমুদ্র তীরবর্তী রামরি শহরের কিয়াউক নি মাও গ্রামে বিমান হামলা চালায় জান্তা বাহিনী। এর ফলে বড়ো আকারের অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং প্রায় ৬০০টি বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। হামলার পর সমুদ্রের ওপর মেঘের কুণ্ডলীর মতো কালো ধোঁয়া উড়ছিল বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা।
এই এলাকাটি আরাকান আর্মির (এএ) নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে বিদ্রোহী এই বাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেছেন, বিমান হামলার সময় সেখানে কোনো লড়াই চলছিল না।
এএ’র মুখপাত্র খাইং থু খা বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে (আরএফএ) বলেছেন, “যেখানে কোনো যুদ্ধ হচ্ছে না সেখানে নিরীহ মানুষকে লক্ষ্য করে আক্রমণ অত্যন্ত ঘৃণ্য এবং কাপুরুষোচিত কাজ। পাশাপাশি এটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ।”
রাখাইনে জান্তা সরকারের মুখপাত্র হ্লা থেইন আরএফএকে জানিয়েছেন, তিনি এই ঘটনা সম্পর্কে অবগত নন। সামরিক বাহিনী-সমর্থিত সামাজিক মাধ্যমের সংবাদ চ্যানেলগুলোতে বলা হয়েছে কিয়াউক নি মাও গ্রামটি আরাকান আর্মির জন্য একটি পরিবহন কেন্দ্র ছিল।
বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধারকারী এক বাসিন্দা বলেছেন, বিমান বাহিনী আবারও যে কোনো সময় ফিরে এসে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে এমন আশঙ্কার মাঝেই ডাক্তাররা আহতদের জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
নিরাপত্তার কারণে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ ব্যক্তি বলেন, “মানুষ সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। গত রাত থেকে আমরা আহতদের চিকিৎসা করে যাচ্ছি, কিন্তু আবারও বিমান হামলার আশঙ্কায় আমরা হাসপাতালে বেশি সংখ্যক রোগী রাখতে সাহস পাচ্ছি না।”
গত বছরের শেষের দিকে আরাকান আর্মি জান্তা সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। বিদ্রোহী বাহিনীটি এখন বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন এই রাজ্যের প্রায় ৮০% নিয়ন্ত্রণ করছে।
গত ২৯ ডিসেম্বর আরাকান আর্মি সরকারি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে গওয়া শহর দখল করে নেয়, যা পুরো রাখাইন রাজ্য দখলের লক্ষ্যে একটি বড়ো পদক্ষেপ। এরপর তারা জান্তার সাথে আলোচনায় প্রস্তুত বলে জানায়। কিন্তু জান্তা সরকার মারাত্মক বিমান হামলার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, বলছেন বাসিন্দারা।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক অভ্যুত্থানে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।
সেনাবাহিনী বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তু করার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে মানবাধিকার কর্মী এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধরত বিভিন্ন বিদ্রোহী বাহিনীর প্রতি জনসমর্থনকে দুর্বল করার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে বেসামরিক এলাকায় নির্বিচারে আক্রমণের কুখ্যাতি অর্জন করেছে।
“সেনাবাহিনী তাদের বিমান দিয়ে শক্তিপ্রদর্শন করছে; বোঝাচ্ছে যে কোনো সময় ইচ্ছামতো মানুষকে হত্যা করা যেতে পারে,” রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেন সহায়তা কর্মী ওয়াই হিন অং।
কিয়াউক নি মাও গ্রামের ওপর এই বোমা বর্ষণ নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর সর্বশেষ রক্তক্ষয়ী হামলা। ২০১৭ সালের আগস্টে এই রাষ্ট্রহীন সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের পর প্রায় ৭,৪০,০০০ রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, গত এক বছর যাবত রাখাইনে যুদ্ধরত উভয় পক্ষের হাতেই রোহিঙ্গারা সহিংসতার শিকার হয়েছে।
বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের জোর করে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের অভিযান শুরু করার পর থেকে আরাকান আর্মি এই মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি কঠোর অবস্থান নেয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট মংডু শহর থেকে সীমান্তবর্তী নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টার সময় কয়েকজন রোহিঙ্গা ড্রোন এবং কামানের গোলায় নিহত হন। বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই হামলার জন্য আরাকান আর্মিকে দায়িক করেছিল। তবে আরাকান আর্মি দায় অস্বীকার করেছে।
………………………………
রেডিও ফ্রি এশিয়া (আরএফএ) বেনারনিউজের সহযোগী একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম।