শুরুতেই হোঁচট খেল চীনা ঋণে স্থাপিত সাগরতলের পাইপলাইন প্রকল্প

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.07.10
ঢাকা
শুরুতেই হোঁচট খেল চীনা ঋণে স্থাপিত সাগরতলের পাইপলাইন প্রকল্প মহেশখালীর গভীর সমুদ্র উপকূলে স্থাপিত সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ের (এসপিএম) মাধ্যমে সৌদি আরব থেকে জাহাজযোগেআসা অ্যারাবিয়ান লাইট ক্রুড অয়েল পরীক্ষামুলকভাবে খালাস করা হয়। ৩ জুলাই ২০২৩। [বেনারনিউজ]
বেনার নিউজ

শুরুতেই হোঁচট খেল চীনা অর্থায়নে বাস্তবায়িত সাগরের তলদেশ দিয়ে অপরিশোধিত তেল সরবরাহের জন্য নির্মিত পাইপলাইন প্রকল্প।  এটি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা ভাসমান জেটি নির্মাণের প্রকল্প হিসেবে পরিচিত।

তিন দফায় প্রকল্প খরচ ও বাস্তবায়নের সময় এক বছর বাড়িয়েও প্রায় ১২০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে সাগর থেকে শোধনাগারে তেল সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি।

সৌদি আরব থেকে আসা প্রায় ৮২ হাজার টন ক্রুড ওয়েল জাহাজ থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ শুরু করা হয়েছিল গত ৩ জুলাই।  কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কারিগরি ত্রুটির কারণে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিতে হয়।  গত এক সপ্তাহের মধ্যে এই ত্রুটি দূর করতে পারেনি চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান।

এর আগে গত ২৫ জুন পরীক্ষামূলকভাবে জ্বালানি তেল খালাস শুরুর কথা ছিল।  তখন বলা হয়, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তেল খালাস করা যায়নি।

ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান সোমবার বেনারকে জানান, ৩ জুলাই তেল সরবরাহ শুরুর কয়েক ঘন্টা পর কারিগরি ত্রুটি সৃষ্টি হয়।  চীনা ঠিকাদার চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড সমস্যা সমাধানে কাজ করছে।  তবে এখনো তা সমাধান করতে পারেনি।

সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা খরচে বাস্তবায়িত প্রকল্পটি আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করার কথা।  তবে এই পরিস্থিতিতে তা সম্ভব হচ্ছে না বলে বেনারকে জানিয়েছেন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জ্বালানি তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল।  বিদেশ থেকে জ্বালানি বোঝাই বড় বড় জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পারে না।  সেগুলো গভীর সমুদ্রে মূলত মহেশখালীর কাছে নোঙ্গর করে।  সেখান থেকে ছোট ছোট (লাইটারেজ) জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দরের সীমানায় অবস্থিত ইস্টার্ন রিফাইনারিতে নিয়ে যাওয়া হয়।  এতে সময় লাগে ১০ থেকে ১১ দিন, খরচও হয় বেশি।  এসব বিবেচনায় প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ।

বড় জাহাজ থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরাসরি অপরিশোধিত তেল সরাসরি পরিশোধনাগারে সরবরাহের জন্য ২০১৭ সালে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল, যার লক্ষ্য ৪৮ ঘন্টায় এক লাখ টন তেল সরবরাহ করা।  এই প্রকল্পটির মাধ্যমে বছরে ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে সরকার দাবি করেছে।

সমস্যার সমাধান করা যায়নি: ইস্টার্ন রিফাইনারি

ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান সোমবার বেনারকে বলেন, “গত ৩ জুলাই এই প্রকল্পের আওতায় নির্মিত পাইপলাইন দিয়ে অপরিশোধিত তেল (ক্রুড ওয়েল) সরবরাহ শুরু হয়।  কয়েক ঘণ্টা পরে সেখানে সমস্যা হলে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।  এখনো সেই সমস্যার সমাধান করা যায়নি।”

“সে কারণে তেলবাহী জাহাজ থেকে লাইটারেজ জাহাজে করে রিফাইনারিতে তেল আনা হচ্ছে,” বলেন তিনি।

লোকমান বলেন, “প্রকল্পটি এখনো চীনা কোম্পানি চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে রয়েছে, আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। সমস্যার সমাধান করে আমাদের কাছে বুঝিয়ে দেবে।”

তিনি আরও বলেন, “একটি সিদ্ধান্ত ছিল যে, যদি ট্রায়াল সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যায় সেক্ষেত্রে আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন।  এখন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না পাইপলাইনটি কবে উদ্বোধন করা যাবে।”

কী ধরনের সমস্যা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে লোকমান বলেন, “পাইপলাইনের সঙ্গে একটি ভাসমান পাইপ থাকে, সেখানে সমস্যা হয়েছে। চীনা কর্মকর্তারা সেটি মেরামত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।”

প্রকল্প শেষ না হলেও সুদ দিতে হবে

তথ্য অধিকার আইনে দেওয়া আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ বেনার প্রতিনিধিকে জানিয়েছে, ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এমপিএম) প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর চীনা এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে সরকার।

শর্ত অনুযায়ী, এই ঋণ ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশেকে পরিশোধ করতে হবে এবং গ্রেস পিরিয়ড পাঁচ বছর। অর্থাৎ ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে একটানা পাঁচ বছর ঋণের কোনো সুদ দিতে হবে না।

সেই হিসাবে গত বছরের নভেম্বরে গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, পাঁচ বছর পার হয়ে গেলে যদি প্রকল্প বাস্তবায়ন না-ও হয়, তবুও সুদ পরিশোধ করতে হবে।

সুদের হার শতকরা দুই ভাগ এবং কমিটমেন্ট ফি হিসাবে যোগ হবে আরও শূন্য দশমিক দুই ভাগ অর্থ। এই প্রকল্পের জন্য সব মিলিয়ে শতকরা দুই টাকা ২০ পয়সা সুদ দিতে হবে।

তিন দফা বৃদ্ধি করে প্রকল্পটির বর্তমান ব্যয় প্রায় ৫৭০ মিলিয়ন চীনা ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে, যা বাংলাদেশি টাকায় আট হাজার ৫৫৫ কোটি টাকার বেশি।

পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য অনুসারে, শুরুতে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় চার হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। প্রথম সংশোধনীর পরে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪২৬ কোটি টাকার বেশি।

দ্বিতীয় সংশোধনীর পর ব্যয় আরও বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৫৬৮ কোটি টাকার বেশি। সর্বশেষ গত বছরের মে মাসে ব্যয় বৃদ্ধি করে বর্তমান খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে।

 কাজ বুঝে নিতে পারেনি বাংলাদেশ: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

চীনা অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের সমস্যা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম বেনারকে বলেন, “যেভাবে আমরা চীনাদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করি সেটি আমাদের জন্য অনুকূল নয়।  এই এসপিএম প্রকল্পের জন্য অর্থায়ন করেছে চীনা এক্সিম ব্যাংক। তারা টাকাটা বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছে এবং ঋণের শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার চীনা কোম্পানিকে ঠিকাদার নির্বাচন করেছে।”

অধ্যাপক তামিম বলেন, “এই চীনা কোম্পানির কাছ থেকে কাজ বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব ইস্টার্ন রিফাইনারির।  কিন্তু তারা সময়মতো এই কাজ করিয়ে নিতে পারেনি।  প্রকল্প দেরি হয়েছে।  এই দেরি হওয়ার কারণে প্রকল্প সমাপ্ত না হলেও আমাদের ঋণের সুদ দিতে হবে গ্রেস পিরিয়ড পার হওয়ার পরদিন থেকেই।”

তিনি বলেন, “একটি ছাড়া চীনা অর্থায়নে বাংলাদেশে বাস্তবায়িত সব প্রকল্প সময় ও অর্থ বৃদ্ধি করে বাস্তবায়িত হচ্ছে বা হয়েছে।  এর কারণ খুব সহজ।  চীনা যে প্রতিষ্ঠান ঋণ দিচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সেই প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা হচ্ছে না। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান চিন্তা করবে, প্রকল্প দেরিতে বাস্তবায়িত হলে তার কোনো সমস্যা নেই। সে তো সুদ এবং আসল দুটোই পাবে।”

“অন্যদিকে ঠিকাদার চিন্তা করবে সময় এবং খরচ বৃদ্ধি করলে তার কোনো ক্ষতি নেই, ক্ষতি বাংলাদেশের। এই সমস্যা সমাধানের একটি উপায় আছে; ঠিকাদার নির্বাচন এবং ঠিকাদারের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব থাকা উচিত অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের, যেটিকে আমরা টার্ন-কি বলে থাকি।  বাংলাদেশ সরকার শুধু ঠিকাদারের কাছে থেকে কাজ বুঝে নেবে,” যোগ করেন তিনি।

কেন টার্ন-কি ভিত্তিতে ঋণ নেওয়া হয় না এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক তামিম বলেন, “বর্তমান ব্যবস্থায় চীন আমাদেরকে টাকা দেয়।  সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ এবং কাজ বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। ঠিকাদার নির্বাচন নিয়ে আমাদের এখানে অনেক সমস্যা আছে।  সে কারণে সরকারি কর্মকর্তারা এই ক্ষমতা ছাড়তে চান না।  ফলে এর খেসারত দিতে হচ্ছে রাষ্ট্রকে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।