মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি পেয়েছে ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি জাহাজ
2024.04.14
ঢাকা
সোমালিয়ার জলদস্যদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ ও এর ২৩ নাবিক মুক্তি পেয়েছেন। বর্তমানে তাঁরা জাহাজটি নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথে রয়েছেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছে জাহাজটির মালিকপক্ষ।
এমডি আব্দুল্লাহর মূল প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম ১৪ এপ্রিল (রোববার) ভোর সোয়া পাঁচটায় বেনারকে বলেন, "জাহাজ ও নাবিকরা দস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। মুক্তি পাওয়ার পর তাঁরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন।"
বার্তা সংস্থা রয়টার্স তাদের প্রতিবেদনে দস্যু দলের দুই সদস্যের কাছে মুক্তিপণ হিসেবে ৫০ লাখ ডলার দেওয়া বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
জলদস্যুদের একজন আবদিরাশিদ ইউসুফ রয়টার্সকে বলেন, “দুই রাত আগে টাকাগুলো আমাদের কাছে আনা হয়েছিল...টাকাগুলো জাল কি না তা পরীক্ষা করে দেখেছি। তারপর আমরা টাকাগুলোকে ভাগ করে সরকারি বাহিনীকে এড়িয়ে চলে যাই।”
জাহাজটির সব ক্রুদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে সোমালিয়া থেকে প্রকাশিত পুন্টল্যান্ড পোস্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণের বিনিময়ে জিম্মিদের গতরাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, “২০১২ সালের পর এই প্রথম সোমালিয়ার জলদস্যুরা মুক্তিপণের অর্থ পেল।”
জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হওয়া নাবিকদের পরিবারের এক সদস্যও বেনারকে জানিয়েছেন, মুক্তিপণের বিনিময়ে জিম্মিদের ছাড়িয়ে আনা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নাবিকের স্ত্রী বেনারকে বলেন, “তিনটি ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগে করে হেলিকপ্টার থেকে জাহাজের কাছে ডলার ফেলা হয়েছে। সেটি নিয়ে নিজেদের নিরাপত্তার নিশ্চিত করে জিম্মিদের মুক্তি দেয়।”
তিনি বলেন, “এর আগে সব নাবিককে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে সবার মাথার পেছনে বন্দুক ঠেকিয়ে রেখেছিল দস্যুরা। কারণ যে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছিল, সেটি ভুয়াও (তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ) হতে পারে।
“নাবিকরা সবাই সুস্থ আছে কি না তা নিশ্চিত করার জন্য সবার হাত উপরে তুলেছে। এরপর হেলিকপ্টার থেকে টাকার (ডলারের) ব্যাগ ফেলেছে,” জানান তিনি।
তবে টাকার পরিমাণের ব্যাপারে কিছু জানাতে পারেননি তিনি।
এমভি আব্দুল্লাহর মালিকপক্ষ আন্তর্জাতিক আইনের কারণে মুক্তিপণের বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে রাজি হয়নি।
রোববার চট্টগ্রামে নিজস্ব কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম বলেন, “সব কিছু আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়মের মধ্যেই করা হয়েছে। (আইন) কোনোটা হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের, কোনটি যুক্তরাজ্যের বা সোমালিয়ার—কিন্তু নিয়মের বাইরে কিছু হয়নি।”
তিনি বলেন, “(দস্যুরা) জাহাজ থেকে নামার আগে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী, প্রতিটি নাবিকের আলাদা ভিডিও নিয়ে সেটা আমাকে পাঠাতে বলেছিলাম। সেটা নিশ্চিত হয়েছি।”
মুক্তিপণের বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি সরকারের পক্ষ থেকেও। রোববার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “মুক্তিপণের মাধ্যমে তাদের ছাড়িয়ে আনার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।”
তিনি বলেন, “ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপ ও সমঝোতার মাধ্যমেই নাবিকদের মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। ভারতীয় নৌ বাহিনী, ইউরোপীয় নৌ বাহিনী এমনকি সোমালিয়ার পুলিশ সহায়তা করেছে।”
দস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথে রয়েছে জাহাজটি, সেখানে আগামী ২০ এপ্রিল নাগাদ পৌঁছাতে পারে বলে জানিয়েছে জাহাজটির মালিকপক্ষ।
রোববার ভোররাতে কেএসআরএম গ্রুপের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম জাহাজটির নাবিকদের মুক্ত হওয়ার খবর বেনারকে নিশ্চিত করেন।
প্রসঙ্গত, আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে বাংলাদেশি পতাকাবাহী এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি গত ১২ মার্চ সোমালিয়ার উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল গভীর সমুদ্রে ভারত মহাসাগরে দস্যুদের কবলে পড়ে।
এরপর গত প্রায় চার সপ্তাহ ধরে সোমালিয়ার গারাকাদ বন্দরের কাছাকাছি জিম্মিদের নিয়ে অবস্থান করছিল। জাহাজ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার নয় দিন পর গত ২০ মার্চ জলদস্যুরা মালিকপক্ষের সঙ্গে যোাগাযোগ শুরু করে।
জাহাজের ভি-সেটের (এক ধরনের যন্ত্র) মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তের অবস্থান জানা যাচ্ছিল উল্লেখ করে মেহেরুল করিম বলেন, “জাহাজটি সোমালিয়ার উপকূলে নেওয়ার পর দস্যুদের কমান্ডারের একজন সহকারীর মাধ্যমে কথা হয়। প্রথম দিনই তাদের পক্ষ থেকে একজন এবং আমাদের পক্ষ থেকেও একজন যোগাযোগকারী ঠিক করি।
“আজ ভোর ৩টার দিকে আমার সাথে জাহাজের ক্যাপ্টেনের যোগাযোগ হয়। তারা (দস্যুরা) ৬৫ জন ছিল জাহাজে। নয়টি নৌকায় করে তারা জাহাজ থেকে চলে গেছে,” জানান তিনি।
মেহেরুল করিম বেনারকে মুক্তিপণের বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এত দ্রুত জাহাজ জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়া নজিরবিহীন ঘটনা
জিম্মিদশা থেকে ৩২ দিনের মাথায় মুক্ত হওয়াকে নজিরবিহীন ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, “এত অল্প সময়ের মধ্যে এ ধরনের ঘটনার সমাধান করা নজিরবিহীন। কারণ এতে অনেক সময় লাগে।”
তিনি বলেন, “আমাদের ইচ্ছা ছিল ঈদের আগের মুক্ত করতে পারব। পারিনি, ব্যর্থ হয়েছি। এই মাসের মধ্যেই পারবো বলে আশা ব্যক্ত করেছিলাম।”
নাবিকরা মুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশে নববর্ষের আনন্দে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কেবল তাদের স্বজনরাই নন, সারা দেশবাসী আনন্দিত।”
১৩ বছর আগে একই কোম্পানির এমভি জাহান মণি নামে আরেকটি জাহাজ সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল, যেটি মুক্ত করতে তিন মাস সময় লেগে যায়।
“আমাদের ঈদের আনন্দ আজ”
নাবিকরা জিম্মি থাকায় তাদের পরিবারে ছিল না ঈদের আনন্দ। তাদের মুক্তির খবর পেয়ে ওইসব পরিবারের এখন ঈদের আনন্দ বিরাজ করছে।
এমভি আব্দুল্লাহর নাবিক নুরউদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বেনারকে বলেন, “আজ মনে হচ্ছে, আমাদের ঈদের দিনের মতো। মুক্তি পেয়ে আমার স্বামীসহ তারা সবাই আনন্দে কান্না করেছে। তারা এখনো আমাদের কাছে নেই কিন্তু এখন স্বস্তিতে আছি।”
তিনি বলেন, “দস্যুরা শারীরিক নির্যাতন করেনি, তবে নাবিকদের ভয় দেখিয়েছে, মানসিক চাপে রেখেছে। মাথায় অস্ত্র ধরতো।”
আরেক নাবিক মোশাররফ হোসেন শাকিলের স্ত্রী জাহানারা আক্তার বেনারকে একটি অডিও বার্তা শুনিয়েছেন, যেখানে শাকিলকে বলতে শোনা যায়, “কোনো সমস্যা নেই, টেনশন করো না।”
শাকিলের ভাই আবু বকর সিদ্দিক বেনারকে বলেন, “এখন ভালো লাগছে, অনেকটা টেনশনমুক্ত হয়েছি।”
জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আতিক উল্লা খানের শ্বশুর মোহাম্মদ ফরিদও বেনারকে জানিয়েছেন যে, তার জামাতা মুক্ত হওয়ার খবর দিয়েছেন।