একযোগে কক্সবাজার জেলা পুলিশে গণবদলী
2020.09.25
কক্সবাজার
ইয়াবা বাণিজ্য, চোরাচালান, মানবপাচার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধের জন্য আলোচিত জেলা কক্সবাজার থেকে একযোগে পুলিশের অন্তত ১ হাজার ৪১৩ কর্মকর্তা ও কনস্টেবলকে বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এদের মধ্যে পুলিশের ১ হাজার ১৪১ জন কনস্টেবলকে শুক্রবার একযোগে বদলি করা হয়।
এর আগে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যার পর উদ্ভূত পরস্থিতিতে তিন দফায় ওই জেলার পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী পুলিশ সুপার ও পরিদর্শকসহ ২৭২ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। এসব পদে নতুন কর্মকর্তা ও সদস্যদের কেউ কেউ শুক্রবার পর্যন্ত যোগ দিয়েছেন, কেউবা যোগ দেওয়ার অপেক্ষায়।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বেনারকে বলেন, বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরের এক প্রজ্ঞাপনে জেলা পুলিশের ১ হাজার ১৪১ জন কনস্টেবলকে বদলি করা হয়েছে। তাঁরা বর্তমানে জেলার আটটি থানা, একাধিক পুলিশ ফাঁড়ি, আদালত, জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত।
“এর আগে তিন দফায় পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে এএসআই পর্যন্ত বিভিন্ন পদে আরও ২৭২ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, জেলা পর্যায়ে একসাথে এত বড় বদলির ঘটনা অার আছে কিনা, এটা তাঁর জানা নেই।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর সদর দপ্তরের নির্দেশে পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনকে রাজশাহীতে বদলি করা হয়। কক্সবাজারে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ঝিনাইদহের এসপি মো. হাসানুজ্জামান।
২১ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমদ স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বদলি করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার আরও সাত কর্মকর্তাকে। ২২ সেপ্টেম্বর আরেক প্রজ্ঞাপনে বদলি করা হয় ২৬৪ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে। এর মধ্যে ৩৪ জন পুলিশ পরিদর্শক, ২৩০ জন এসআই এবং এএসআই।
এসপি মো. হাসানুজ্জামান শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ সদর দপ্তরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুরানোরা চলে যাবেন এবং নতুনেরা তাদের স্থলে দায়িত্ব পালন করবেন।
তবে পুলিশ সদর দপ্তর কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে বিষয়ে বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পুলিশ সদর দফতরের মুখপাত্র (এআইজি-মিডিয়া) সোহেল রানা এ বিষয়ে দাপ্তরিক বক্তব্য দেওয়ার জন্য বেনারের কাছে সময় চেয়েছেন।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, কক্সবাজার জেলা পুলিশকে নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এরই অংশ হিসাবে জেলায় দায়িত্ব পালন করা শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সিপাহি পর্যন্ত সবাইকে বদলি করা হচ্ছে।
“সর্বমোট ১৫০৭ জন পুলিশ সদস্য কক্সবাজারে যোগদান করবে এবং পূর্বে যারা কর্মরত ছিল তারা সকলে চলে যাবে,” জানান তিনি।
“কক্সবাজারে ইতিপূর্বে যারা কর্মরত ছিল তারা সকলে ভালো কাজ করেছে। ভবিষ্যতে আরও ভালো কাজ করার জন্য আমরা ‘টোটাল চেঞ্জ’ করছি,” বলেন তিনি।
জেলা পর্যায়ে পুলিশের গণবদলীর ঘটনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
কক্সবাজার জেলা আইনজীবি সমিতির সাবেক সাধারন সম্পাদক ইকবালুর রশিদ আমিন সোহেল বেনারকে বলেন, “কক্সবাজার জেলা পুলিশে কিন্তু অনেক সৎ কর্মকর্তাও ছিলেন। করোনাকালে পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের অনেকেই এখানে অনেক ভাল কাজ করেছেন। কিন্তু সিনহা হত্যার ঘটনায় পুলিশের সব অর্জন ভেস্তে গেছে।”
“জেলা পুলিশে অনেক ভালো অফিসার থাকা সত্ত্বেও কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে আজ পুলিশের এই অবস্থা। আমি মনে করি, এই গণবদলী সেসব অসাধু পুলিশ সদস্যদের জন্য সর্তক বার্তা,” যোগ করেন ইকবালুর রশিদ।
সিনিয়র এই আইনজীবী আরও বলেন, কক্সবাজার যেহেতু ইয়াবা চোরাচালানের রুট, সেই সুবাদে অতীতে আমরা দেখেছি একই এলাকায় দীর্ঘদিন চাকরি করতে গিয়ে অনেকে ইয়াবা কারবারীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে, তাদের সঙ্গে আঁতাত করেছে। বিশেষ করে তাদের জন্য এবং নতুন যারা দায়িত্ব নেবেন তাদের জন্য এই বদলী বড় একটি বার্তা।
গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনার পর থেকে পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা-প্রতিক্রিয়া শুরু হয়।
ক্রসফায়ারে হত্যা ২৭০
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালের ৪ মার্চ থেকে দেশে মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার হওয়ার পর থেকে এ বছর ১ আগস্ট পর্যন্ত জেলায় ২৭০টি ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটে। এদের মধ্যে দুই নারীসহ ১০৪ জন রোহিঙ্গা।
তবে গত ৩১ আগস্ট টেকনাফের শামলাপুরের পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এ পর্যন্ত ক্রসফায়ারের ঘটনা আর ঘটেনি।
তবে ঘটনার পর থেকে পুলিশের টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অাদালতে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা ও চাঁদাবাজির অভিযোগে অন্তত এক ডজন মামলা হয়েছে।
এর আগে ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর টেকনাফের এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ১৭ লাখ টাকা আদায়ের ঘটনায় সেনাবাহিনীর হাতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ৭ সদস্য আটক হন।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বেনারকে বলেন, মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ড এবং মাদক ও অপরাধমুক্ত কক্সবাজার গড়তে পুলিশকে ঢেলে সাজানোর বিষয়টি ইতিবাচক। তবে এসব বিষয় বাস্তবায়ন করতে নবাগত পুলিশ সুপারকে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট কাটিয়ে তুলতে হবে।”
স্থানীয় সুশীল সমাজের এই প্রতিনিধি বলেন, জেলার পুরানো পুলিশ সদস্যদের একযোগে বদলী করায় মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখতে কিছুটা বেগ পেতে হতে পারে।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে শরীফ খিয়াম।