দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি থেকে শতাধিক আটক, নানা পেশার মানুষের অংশগ্রহণ
2024.07.31

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ হত্যা, আন্দোলনকারীদের ছয় সমন্বয়ককে নিরাপত্তার নামে আটকে রাখা ও পূর্বঘোষিত ৯ দফা দাবি আদায়ের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে বুধবার শতাধিক বিক্ষোভকারী আহত হয়েছেন। সারা দেশে গ্রেপ্তারের সংখ্যাও প্রায় একশ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচিতে বুধবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর কড়া নজরদারির মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ছাড়াও শিক্ষক, অভিভাবক, আইনজীবী ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিরা অংশ নেন।
তাদের এই অংশগ্রহণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। গত ২০ জুলাই কারফিউ জারি করার পর এই প্রথম দেশের বিভিন্নস্থানে বিপুলসংখ্যক মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেন।
এদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, খুলনাসহ বড় বড় মহানগর ও জেলা শহরে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে নানা রকম স্লোগান দেয়।
ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে শতাধিক আহত হয়েছেন।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে ছাত্ররা জেলা ও মেট্রোপলিটন আদালতের দিকে মিছিল করার সময় পুলিশের সাথে কয়েকটি স্থানে এই ঘটনাগুলো ঘটে।
ঢাকার হাইকোর্ট এলাকায় কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে যেতে চাইলে শিক্ষক ও আইনজীবীরা পুলিশের হাত থেকে তাদের ছাড়িয়ে নেন। এসময় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা যায়।
ঢাকার হাইকোর্টের সামনে অন্তত তিন ঘণ্টা বিক্ষোভ করেছেন শত শত শিক্ষার্থী। হাইকোর্টের সামনে বিক্ষোভে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকরাও যোগ দেন।
হাইকোর্টের সামনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দিতে পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ব্যারিকেড ভেঙে একদল আইনজীবী আদালত চত্বরে কর্মসূচি পালন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে দুই জন শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় বাধা দিলে একজন শিক্ষকও আহত হন।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোঃ আকতারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “পুলিশের হাতে শিক্ষক নিগ্রহের কোন ঘটনা ঘটেনি। তিনি ভিড়ের মধ্যে আঘাত পেয়ে থাকতে পারেন।”
হাইকোর্ট এলাকায় সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক লুৎফুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীরা এখন গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছে। মেসে, বাসাবাড়ি বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে থাকতে পারছে না।
“আমরা হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই এবং গণগ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা ও পুলিশি অভিযানের অবসান চাই,” বলেন তিনি।

বুধবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক রিফাত বেনারকে বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচিতে চরম ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যেও দেশজুড়ে সাধারণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, আইনজীবী অন্যান্য শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ যেভাবে রাস্তায় নেমে এসেছেন, তাতে প্রমাণিত হয় মানুষ জুলুমের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।”
গত কয়েক দিনের মতো তীব্রতর না হলেও বুধবারও বিভিন্ন স্থানে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অন্যান্য শ্রেণি পেশার মানুষ পুলিশের হামলার শিকার হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, কয়েকটি স্থানে পুলিশ নিরস্ত্র মানুষের ওপর টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুঁড়েছে।
সিলেট নগরের সুবিদবাজার এলাকায় পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জে শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন।
বরিশাল ও খুলনায় পুলিশ নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপক চড়াও হয়ে লাঠিপেটা করেছে পুলিশ এবং বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে।
বরিশালে ৪ সাংবাদিকসহ অন্তত ১০ জন আহত হওয়ার তথ্য দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ সময় কয়েকজন আন্দোলনকারীকে আটক করে পুলিশ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকেরাও অংশ নেন। এ ছাগড়া বিভিন্ন
এসব ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে রিফাত বলেন, “প্রাথমিক তথ্যে আমরা জানতে পেরেছি শতাধিক আন্দোলনকারী আজও আহত হয়েছে এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ চলাকালে শতাধিক আন্দোলনকারীকে আটক করেছে পুলিশ।”
তিনি বলেন, “আমরা চাই এই জুলুমের অবসান হওয়া পর্যন্ত দেশের সর্বস্তরের মানুষ আমাদের সঙ্গে থেকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে সফল করবেন।”
নতুন কর্মসূচি রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস
বুধবার মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি শেষে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ নামে বৃহস্পতিবারের জন্য নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
এক বিবৃতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক রিফাত রশিদ বলেন, “এমন ভয়ানক অন্ধকার পরিস্থিতিতে সারাদেশে ছাত্র-জনতার উপর গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও শিক্ষকদের উপর ন্যাক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে, জাতিসংঘ কর্তৃক তদন্তপূর্বক বিচারের দাবিতে এবং ছাত্র সমাজের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস কর্মসূচি ঘোষণা করছে।”
এই কর্মসূচিতে করণীয় সম্পর্কে বিবৃতিতে বলা হয়, নির্যাতনের ভয়ংকর দিন-রাতগুলোর স্মৃতিচারণ; শহীদ ও আহতদের নিয়ে পরিবার এবং সহপাঠীদের স্মৃতিচারণ; এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোনলে হওয়া নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে চিত্রাঙ্কন/গ্রাফিতি, দেওয়াল লিখন, ফেস্টুন তৈরি, ডিজিটাল পোট্রের্ট তৈরি প্রভৃতি।
কোনোদিন ভাবতে পারিনি এতগুলো তাজা প্রাণ যাবে: প্রধানমন্ত্রী
বুধবার ঢাকায় জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “আন্দোলনের নামে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে ধ্বংসাত্মক কাজ ঘটেছে। অনেকগুলি প্রাণ ঝরে গেছে। আমি কোনোদিন ভাবতে পারিনি যে এসময় ধরনের একটা অবস্থার সৃষ্টি হবে। আর সেখানে এতগুলো তাজা প্রাণ যাবে।”
স্বজনহারার বেদনা নিয়ে বেঁচে আছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি জানি একজন আপনজন হারালে কী কষ্ট হয়। যে কোটা আমি সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দিয়েছিলাম, হাইকোর্টের রায়ে সেটা আবার যখন নিয়ে আসা হয় সরকারের পক্ষ থেকে আমরা আপিল করি। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে দিয়ে পূর্ণাঙ্গ শুনানির তারিখ নির্দিষ্ট করে দেয়। আবার সেই কোটা ফিরে আসে, কোটা আর থাকবে না আমার জারিকৃত প্রজ্ঞাপনটাই আবার কার্যকর হয়।”
আন্দোলনের প্রতিটি দাবি মেনে নেওয়া হয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, “কিন্তু তারপরেও এই আন্দোলনের নামে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে ধ্বংসাত্মক কাজ ঘটেছে...।”

দুই সপ্তাহ পর ফিরলো ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ
দুই সপ্তাহ পর বাংলাদেশি ব্যবহারকারীরা আবারও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও টিকটকে প্রবেশ করতে পারছেন। বুধবার স্থানীয় সময় বেলা দুইটার পর খুলে দেয়া হয়েছে চালু হয়েছে এই সাইট ও অ্যাপগুলো।
এদিস সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মালিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে এই সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হলে ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়।
পাঁচ দিন পর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত পরিসরে এবং ১০ দিন পর মোবাইল ইন্টারনেট চালু হলেও বন্ধ ছিলো ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
বাংলাদেশের অংশীদারত্ব চুক্তির আলোচনা স্থগিত করেছে ইইউ
বাংলাদেশের সঙ্গে আগামী সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম দফা অনুষ্ঠিতব্য একটি আলোচনা স্থগিত করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতার মধ্যে নতুন অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি বিষয়ে এই আলোচনাটি স্থগিত করলো ইইউ। তবে আলোচনার জন্য নতুন কোনো তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির আওতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিয়ে থাকে।
গত বছরের ২৫ অক্টোবর নতুন ইইউ–বাংলাদেশ অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির বিষয়ে আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত হয়।