সুইডিশ রেডিওতে ক্রসফায়ারের বর্ণনা দিলেন সাবেক র্যাব কর্মকর্তা
2017.04.04
ঢাকা
‘যদি ধরতে পারো, সে যেখানেই থাকুক, তাকে গুলি করে মারবে, তারপর পাশে একটা অস্ত্র রেখে দেবে’- র্যাবের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি শীর্ষ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা থাকে এমন।
মঙ্গলবার অডিও ক্লিপসহ এমনই একটি প্রতিবেদন প্রচার করে সুইডিশ রেডিও। বলা হচ্ছে, ওই ক্লিপের বক্তব্য র্যাবের সাবেক শীর্ষ একজন কর্মকর্তার।
তবে সুইডিশ রেডিওতে প্রচারিত ওই প্রতিবেদনে যেসব অভিযোগের কথা বলা হয়েছে বরাবরের মতো র্যাব তা অস্বীকার করেছে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বেনারকে জানিয়েছেন, র্যাবের কোনো কর্মকর্তা এমন সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বলে তাঁর জানা নেই। ক্রসফায়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
“র্যাব একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। প্রতিষ্ঠার পর থেকে র্যাব লাখ লাখ সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার করেছে। অভিযানের সময় তারা গুলি ছোড়ে। র্যাবকেও বাধ্য হয়ে গুলি ছুড়তে হয়,” বলেন মুফতি মাহমুদ খান।
সুইডিশ রেডিও বলছে, র্যাবের ওই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা শিকার ঠিক করা, তুলে নেওয়া, হেফাজতে নির্যাতন থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা আলাপ করেন। তাঁকে না জানিয়েই সাক্ষাৎকারটি রেকর্ড করা হয়। ওই রেকর্ডটি ছিল বাংলায়।
সুইডিশ রেডিওতে প্রচারিত ওই র্যাব কর্মকর্তার স্বীকারোক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনে জমা ভুক্তভোগীদের নালিশ কিংবা দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগের মিল রয়েছে।
দেশের অপরাধ দমনকারী বিশেষ এই বাহিনীটির এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক।
তিনি বেনারকে বলেন, “এভাবে চলতে পারে না। এই সমস্যার সমাধান জরুরি।”
তিনি জানান, “র্যাবের বিরুদ্ধে গুম, খুন, অপহরণের অভিযোগ নিয়ে অনেকেই মানবাধিকার কমিশনে আসেন। কিন্তু কিছু আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে র্যাব বা পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ তদন্ত করতে পারে না কমিশন। শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করতে পারে। তবে আমি মনে করি অভিযোগের সুরাহা হওয়া দরকার।”
গল্পে গল্পে যা বললেন র্যাব কর্মকর্তা
এমন অনেক অপরাধী আছে যারা ভয়ংকর সব অপরাধ করেছে কিন্তু স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়ায় তাদের বিচার বা পুনর্বাসন সম্ভব না, তাদেরকেই হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে উল্লেখ করেন ওই র্যাব কর্মকর্তা। শিকার ধরার সময় বেশ চালাকির আশ্রয়ও নেন তাঁরা।
হেফাজতে নির্যাতনের ব্যাপারে ওই নাম না জানা র্যাব কর্মকর্তা বলেন, “একটি অন্ধকার কক্ষের মাঝখানে আলো জ্বেলে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে পুরোপুরি অনাবৃত করে ফেলা হয়। তারপর তার অণ্ডকোষে ইটের টুকরো ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। একসময় যন্ত্রণায় ওই ব্যক্তি অচেতন হয়ে পড়েন।”
একইভাবে খুনের পর মৃতদেহগুলোর সাথে ভারী ব্লক বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন ওই র্যাব কর্মকর্তা।
“র্যাব কর্মকর্তারা ‘ক্রসফায়ার’ এর আগে ও পরে খুব সতর্কতা অবলম্বন করেন। পরিচয়পত্র পড়ে গেল কি না দেখেন। হাতে দস্তানা পরেন, পায়ের ছাপ যেন না থাকে সে জন্য জুতাও ঢেকে রাখেন। কোনোভাবেই যেন খুনের কোনো চিহ্ন না থাকে সে জন্যই বাড়তি সতর্কতা। ক্রসফায়ারের পর র্যাবের অভিযানে অংশগ্রহণকারী থেকে শুরু করে যারা গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন, তাঁরা সবাই একই গল্প বলেন,” র্যাব কর্মকর্তা বলেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের উদ্বেগ
মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে র্যাব যেসব অপরাধ করে এসেছে তার রেকর্ড রাখছে এবং সমালোচনাও করে আসছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। র্যাবের হাতে নিহত, অপহৃত ও নির্যাতিত ব্যক্তির স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন সংগঠনটির কর্মকর্তা উলফ ব্লমকভিস্ত।
সুইডিশ রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমরা এই রেকর্ডিং এ যা শুনেছি, তার সঙ্গে আগেকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো মিল যায়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ধরনের ঘটনা কয়েক বছর ধরে প্রত্যক্ষ করছে ও রেকর্ড রাখছে। যারা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয় তাঁদের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন থাকে, কিংবা ফাঁস লাগা অবস্থায় পাওয়া যায়,” বলেন উওলফ।
মানবাধিকার সংগঠন ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, খুব কম সময়েই অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মামলার রায় ঘোষণার পর তাই সারা দেশে সাড়া পড়ে যায়। র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখার দাবি তোলে ভুক্তভোগী বহু পরিবার।
সুইডিশ রেডিওর সাক্ষাৎকারে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল র্যাবের অভিযুক্ত সদস্যদের বিরুদ্ধে বিচার না হওয়ার প্রসঙ্গে যা বলেছে তা মিলে যায় বেশ কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে।
বিচারের অপেক্ষায় ভুক্তভোগী
২০১৪ সালের মে মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহনূর আলম নামে এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে র্যাবের বিরুদ্ধে। হেফাজতে থাকা অবস্থায় ওই বাহিনীর সদস্যদের নির্যাতনে তিনি মারা যান ওই একই বছরের ৭ মে। তাঁর ভাই মাহাদী হাসান আদালতে মামলা করলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুন নাহার। পরে নাজমুন নাহারকে আমলী আদালত থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। মাহাদী বলছিলেন, নাজমুন নাহারের আদালতে ভাইয়ের বিচারের জন্য তাঁরা হাইকোর্ট রিট করেছেন। কাজ হচ্ছে না।
“দুই-তিন মাস পর রিটের শুনানির একটা তারিখ পড়ে। আমি কাগজপত্র নিয়ে যাই। শুনানি কখনো হয়। কখনো হয় না। কিন্তু হাইকোর্ট কোনো আদেশও দেন না। তিন বছর হতে চলল, বিচারই শুরু হলো না”, বেনারকে বলেন মাহাদী।