ঢাকায় ট্রেনে আগুনে চার মৃত্যু: একে অপরকে দুষছে সরকার ও বিরোধীরা
2023.12.19
ঢাকা
বাংলাদেশে বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধীদের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল শুরুর অল্প সময় আগে ঢাকায় একটি ট্রেনে অগ্নি সংযোগের ঘটনায় একই পরিবারের দুইজনসহ মারা গেছেন কমপক্ষে চারজন যাত্রী।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার জন্য বিএনপিকে দায়ী করেছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন ও ঢাকার পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান।
তবে আগুনে নিহত চার ব্যক্তির একজনকে নিজেদের নেতা দাবি করে ঘটনার সঙ্গে সরকারের সম্পৃক্ততা রয়েছে দাবি করে এই ঘটনায় নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে বিরোধী দল বিএনপি।
এক সপ্তাহের কম সময়ের ব্যবধানে মঙ্গলবার ভোরে নাশকতার শিকার হয় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস।
এদিন ট্রেনে আগুনে পুড়ে প্রাণ হারালেন নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তাঁর তিন বছরের শিশু সন্তান ইয়াসিনসহ মোট চারজন।
বাকি দুজনের মধ্যে একজন নেত্রকোণা জেলা বিএনপি’র জেষ্ঠ্য সদস্য, নেত্রকোণা পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাবেক সভাপতি ও জেলা যুবদল নেতা আব্দুর রশিদ ঢালী।
অপরজনের পরিচয় মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
হরতাল শুরুর আগেই ট্রেনে আগুন
রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি সোমবার রাত ১১টায় ঢাকা কমলাপুর স্টেশনের উদ্দেশ্যে নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলা ছাড়ে। ট্রেনটি সোয়া চারটায় ঢাকা পৌঁছানোর কথা ছিল। তবে ঘণ্টা খানেক বিলম্বে চলাচল করছিল ট্রেনটি।
ঢাকা রেলওয়ে জেলার পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বিমান বন্দর স্টেশন ছাড়ার তিন থেকে চার মিনিট পর ‘জ’ এবং ‘ঝ’ বগির মাঝখানে থাকা রাবারে আগুন ধরে যায়। ওই বগিতে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিল। সেটি দিয়ে আগুন নেভানো হয়।”
তিনি বলেন, “এর তিন থেকে চার মিনিট পর সেখান থেকে আবার আগুন জ্বলতে শুরু করে এবং সেখান থেকে অন্যান্য বগিতে ছড়িয়ে পড়ে।”
আনোয়ার হোসেন বলেন, “ওই ট্রেনের নিরাপত্তার জন্য মোট তিনজন পুলিশ সদস্য কর্তব্যরত ছিল। তারা ওই বগি থেকে অন্য বগিতে চলে আসার পর পরই সেখানে আগুন লাগে। বিমান বন্দর স্টেশনের পরে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে এই ট্রেনের কোনও কোন স্টপেজ ছিল না। সেকারণে ট্রেনটি থামেনি। পরে ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে থামে।”
তিনি বলেন, আগুনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের তিনটি বগি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে এবং আগুনের সূত্রপাত হওয়ার সময় অধিকাংশ যাত্রী ঘুমিয়ে ছিলেন। তেজগাঁও স্টেশনে থামার পর দমকল বাহিনী আগুন নেভায়।
ট্রেনে আগুনের ঘটনা এমন সময় ঘটে যখন যেদিন সকাল ছয়টা থেকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এবং আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনের তফসিল বাতিলেরর দাবিতে দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি শুরু করে।
পরস্পরকে দায়ী করছে সরকার ও বিরোধীরা
ট্রেনে আগুনের ঘটনায় সরকার ও পুলিশ বিএনপিকে দায়ী করেছে। অপরদিকে বিএনপিও সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে পরিকল্পিত নাশকতার।
রেলভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন মঙ্গলবার বলেন, নাশকতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নিরাপদ রেলযাত্রাকে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে।
“গত ২৮ অক্টোবরের পর বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো যে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিচ্ছে, এই সময়ে রেলে সহিংসতা বাড়ছে। রেলকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মধ্যে ফেলে হুমকি তৈরি করা হচ্ছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে যোগাযোগব্যবস্থায় যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল, সেখানে একমাত্র রেল চলাচল স্বাভাবিক ছিল। এখন রেল যোগাযোগব্যবস্থায় পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শনকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার জন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দায়ী।
“এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট। এসব তাদের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত। বিদেশি নেতাদের নির্দেশে তাদের দেশীয় এজেন্টরা এসব কাজ করছে,” বলেন তিনি।
তবে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ট্রেনে আগুনের ঘটনায় সরকার জড়িত।
“সরকার নাশকতা করে হরতাল-অবরোধকারীদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে,” বলেন তিনি।
এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ‘মানবতার শত্রু’ উল্লেখ করে রিজভী বলেন, “একই ট্রেন কয়েক দিন আগে লাইনচ্যুত হয়েছিল। একই ট্রেন দুবার আক্রান্ত হয়েছে। এই ট্রেনের নিরাপত্তা কোথায়? এ ঘটনার সঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতার সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, সরকার এর জন্য দায়ী।”
তবে রেলের সাবেক কর্মকর্তারা এই ঘটনার জন্য কর্তব্যরত রেল কর্মচারী-কর্মকর্তাদের দায়ী করেছেন। তাঁদের মতে, আগুন ধরার পর ট্রেনটি থামালে আগুন নেভানো যেতো এবং তাতে মৃত্যু ঠেকানো যেতো।
স্বজনের আহাজারি
ট্রেনে আগুনে প্রাণ হারান পপি এবং তাঁর ছেলে ইয়াছিন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে রাখার পলিথিন ব্যাগে পপির লাশের সাথে তাঁর ছেলের লাশ রাখা হয়েছে। মা সন্তানকে বাঁচানোর জন্য জড়িয়ে ধরে ছিলেন।
তবে পপি ও তার ছেলে প্রাণ হারালেও তাঁর সহযাত্রী দুই ভাই কামরা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন।
কাওরানবাজারে ব্যবসা করেন পপির স্বামী মিজানুর রহমান। শোকে মুহ্যমান মিজানুর।
তাঁর ভাই দেলোয়ার হোসেন টিটু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, দুই সন্তান ও ছোট কিশোর ভাইকে নিয়ে ঢাকায় আসার জন্য ট্রেনে উঠেছিলেন পপি। ট্রেনে আগুন লাগলে তাঁর বড় ছেলে এবং কিশোর ভাইটি ট্রেন থেকে নামতে পারলেও আটকা পড়েন পপি ও ছোট ছেলে ইয়াসিন।
অপরদিকে রশিদ ঢালীর ছেলে মো. মামুন ঢালী নেত্রকোনার বাড়ির উঠানে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, “আমার বাবা ব্যবসার কাজে ঢাকা গেছিল ট্রেইনে। বাবা, জীবনের লাইগ্যা গেছে গা। আর আইব না।”
পুড়ে যাওয়া ট্রেন ঘিরে নানা প্রশ্ন
বেনার প্রতিবেদক মঙ্গলবার ট্রেনটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রত্যক্ষ করেছেন। দেখা গেছে ‘ঞ’, ‘জ’ এবং ‘ঝ’ বগির অভ্যন্তর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ‘জ’ এবং ‘ঝ’ বগির মাঝখানে স্থাপতি রাবারের ওপর দিকে আগুন লাগার চিহ্ন থাকলেও নীচের দিকটি রয়েছে অক্ষত।
বগি তিনটির জানালাসহ বিভিন্ন লোহার কাঠামো গলে গেছে।
তেজগাঁও স্টেশনের সহকারী ব্যবস্থাপক পর্বত আলী বেনারকে বলেন, তিনি কর্তব্যরত ছিলেন এবং ভোর চারটা ৫০ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে তাঁকে জানানো হয় যে, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস কমলাপুর স্টেশনের উদ্দেশ্যে ছেড়েছে।
তিনি বলেন, “ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে থামার কথা নয়। তবে আমি দেখছিলাম ট্রেনের বগি থেকে আগুন ও ধোঁয়া বের হচ্ছে। মানুষের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। এটি দেখে আমি ট্রেনটি থামাই। তখন সময় চারটা বেজে ৫৮ মিনিট। আমি দমকল বাহিনীকে খবর দিই। তারা সোয়া পাঁচটার দিকে আগুন নেভাতে কাজ শুরু করে।”
পর্বত আলী বলেন, “ট্রেন থামার পর আমরা সকল যাত্রীকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিই। সকাল সাতটার দিকে ট্রেনটি কমলাপুর স্টেশনে চলে যায়।”
রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক তহিদুল আনোয়ার চৌধুরী মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, যারা আগুন দিয়েছে তারা তো দোষী বটেই। তবে যারা এই আগুন নেভাতে পারেনি তাদেরও দোষ কম নয়।
তিনি বলেন, “অ্যাটেন্ডেন্ট যখন দেখল আগুন লেগেছে তখন তার দুটি কাজ। প্রথমটি হলো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দিয়ে আগুন নেভানো। এই কাজ করতে এক থেকে দুইজন মানুষ লাগে।”
“অ্যাটেন্ডেন্টের আরেকটি কাজ হলো, সে তৎক্ষণাৎ বিষয়টি কন্ট্রোলকে জানাবে। তখন কন্ট্রোল বিষয়টি নিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেবে এবং ম্যানুয়াল অনুযায়ী সবাই সবার কাজ করবে, পরবর্তী স্টেশনে বিষয়টি জানিয়ে দেবে,” যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, “আগুন লাগানোর সাথে সাথে যদি ট্রেনটি থামানো যেত অথবা ডিকাপলিং করা যেত তাহলে আগুনটি ছড়াতো না।”
বাংলাদেশ রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক এ.এম. সালাহ উদ্দীন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আগুনটি নেভানোর পর আবার আগুন জ্বলে ওঠে। কিন্তু অ্যাটেন্ডেন্ট কেন কন্ট্রোলে বিষয়টি জানায়নি, সে বিষয়টি আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়।”
তিনি বলেন, “আমরা পুরো ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছি।”
সালাহউদ্দিন বলেন, “তদন্তে আমরা দেখব আমাদের ঘাটতি কোথায় ছিল এবং এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করব।”
গত ১৩ ডিসেম্বর ফিশপ্লেট খুলে ফেলায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের সাতটি বগি গাজীপুরের কাছে উল্টে যায়। ওই ঘটনায় প্রাণ হারান এক ব্যক্তি।
দুই ঘটনাকেই পুলিশ ও সরকারি প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিরোধীদলের নাশকতা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।