শিশু রাজন হত্যায় ৪ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল, সাজা কমল একজনের

জেসমিন পাপড়ি
2017.04.11
ঢাকা
সিলেটে শিশু রাজন হত্যা মামলার প্রধান আসামি কামরুল সিলেটে শিশু রাজন হত্যা মামলার প্রধান আসামি কামরুল। ফাইল ফটো।
স্টার মেইল

সিলেটের শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলায় প্রধান আসামি কামরুল ইসলামসহ চার আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে হাই কোর্ট। অন্য তিন আসামির সাত বছর করে কারাদণ্ড ও দুই আসামির এক বছর করে সাজার রায়ও বহাল রয়েছে। তবে একজনের যাবজ্জীবন সাজা কমিয়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

মঙ্গলবার বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।

এ ছাড়া এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি বন্ধে সামাজিক আন্দোলন ও আইন সম্পর্কে সচেতনতার বিষয়টি প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলেও রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে আদালত।

এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত রায় কার্যকরের আশা করেছে শিশু রাজনের পরিবার। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দৃষ্টান্তমূলক এ রায় দেশে শিশু নির্যাতন বন্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।

এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী এলিনা খান বেনারকে বলেন, “প্রধান আসামিসহ অন্যান্যদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা সন্তোষজনক। এই রায় দেশে শিশু নির্যাতন বন্ধে সহায়ক হবে।”

যা ঘটেছিল

২০১৫ সালের ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে চুরির অভিযোগ তুলে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ১৩ বছরের শিশু রাজনকে। নির্যাতনের সে দৃশ্য ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয় হত্যাকারীদেরই এক সহযোগী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সে ভিডিও সারা দেশে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে।

মাত্র চার মাসের মাথায় ওই বছরের ৮ নভেম্বর আলোড়ন সৃষ্টি করা মামলাটির রায়ে চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় সিলেটের মহানগর দায়রা জজ আদালত। পাশাপাশি একজনকে যাবজ্জীবন এবং পাঁচজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।

রাজনকে হত্যার পরপরই লাশ গুম করার সময় স্থানীয়রা মুহিত আলম নামে একজনকে আটক করে পুলিশে দেয়। পরে পুলিশ মুহিত, তার ভাই কামরুল ইসলাম ও আলী হায়দার এবং ময়না মিয়া চৌকিদারসহ অজ্ঞাত পরিচয়ের আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করে।

এরই মধ্যে সৌদি আরবে পালিয়ে যান রাজন হত্যার প্রধান আসামি কামরুল। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখে সৌদি আরবের প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাকে আটক করে। এরপর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হয়।

শুনানি চলাকালে ভিডিও ফুটেজকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ না করার আবেদন জানায় আসামিপক্ষ। তবে এর পেছনে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে হাই কোর্ট জানিয়েছে, এই মামলায় ভিডিও ফুটেজটি অবশ্যম্ভাবীভাবে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য। ভিডিও ফুটেজে প্রতীয়মান হয়, নির্যাতনের কারণেই ঘটনাস্থলে শিশুটি মারা যায়।

সন্তুষ্ট রাজনের বাবা

উচ্চ আদালতে রায় ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন রাজনের বাবা শেখ মো. আজিজুর রহমান।

রায় ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বেনারকে বলেন, “হাই কোর্টের রায়ে আমি সন্তুষ্ট। আদালতের এ রায় দ্রুত কার্যকর চাই আমি। তা ছাড়া আসামিরা আপিল করলে সেখানেও যেন এই রায় বহাল থাকে।”

তবে রায়ে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হয়নি জানিয়ে এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করবেন বলে বেনারকে জানান আসামিপক্ষের আইনজীবী এস এম আবুল হোসেন।

দণ্ডপ্রাপ্ত যারা

নিম্ন আদালতের রায়ে প্রধান আসামি কামরুল ইসলামসহ চারজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকি আসামিরা হলেন, স্থানীয় চৌকিদার সাদেক আহমদ ওরফে বড় ময়না (৩৫), শেখপাড়া গ্রামের তাজউদ্দিন আহমদ ওরফে বাদল (২৪) ও সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ঘাগটিয়া গ্রামের জাকির হোসেন ওরফে পাবেল ওরফে রাজু মিয়া (২০)। উচ্চ আদালতে এ রায় বহাল রয়েছে।

সাত বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে প্রধান আসামি কামরুলের তিন ভাই মুহিত আলম, আলী হায়দার ওরফে আলী ও শামীম আহমদকে। এ ছাড়া ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দুলাল আহমদ ও আয়াজ আলীকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।

আগে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া ব্যক্তির নাম নূর মিয়া। তিনিই রাজনকে নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন। মঙ্গলবারের রায়ে তার সাজা কমিয়ে ছয় মাসের কারাদণ্ডের রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। এসব আসামিদের মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জাকির হোসেন এবং সাত বছর কারাদণ্ড পাওয়া শামীম আহমদ মামলার শুরু থেকেই পলাতক রয়েছে।

উচ্চ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আতিকুল ইসলাম ও নিজামুল হক নিজাম। আসামিপক্ষে শুনানি করেন এস এম আবুল হোসেন, বেলায়েত হোসেন, মো. শাহরিয়ার ও শহীদ উদ্দিন চৌধুরী। পলাতক দুই আসামির পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হাসনা বেগম।

প্রাথমিক শিক্ষায় আইন-সচেতনতা থাকা উচিত: আদালত

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, যথাযথ শিক্ষার অভাবে দেশের অধিকাংশ মানুষের আইন সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান নেই। আইন ও আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতা ও শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ। আইন সম্পর্কে সচেতনতার জন্য বিষয়টি প্রাথমিক শিক্ষায়ও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

আদালত জানায়, সচেতনতা ও আইনের প্রাথমিক প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

পুলিশ ছাড়া যেকোনো অভিযোগে কোনো সাধারণ ব্যক্তি কাউকে আটক করলে তাৎক্ষণিকভাবে তা পুলিশকে জানাতে হবে বলে মত দিয়েছে আদালত।

এই মামলায় আসামিপক্ষের দাবি, ভ্যান চুরি করার কারণে বিক্ষুব্ধ জনতা রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। তবে কোনো পক্ষের সাক্ষ্যে তা প্রমাণিত হয়নি বলে জানায় আদালত।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজন সেখানে দলগতভাবে পশুর মতো আচরণ করেছে জানিয়ে আদালত জানায়, তারা মানবিকতা হারিয়ে অমানবিক আচরণ করেছিল।

মৃত্যুদণ্ড বেড়েছে বাংলাদেশে

সম্প্রতি প্রকাশিত বিভিন্ন দেশের মৃত্যুদণ্ডের পরিসংখ্যান নির্ভর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর গ্লোবাল রিপোর্ট ২০১৭ অনুযায়ী ২০১৬ সালে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পরিমাণ ছিল আগের বছর থেকে আড়াই গুণ বেশি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ৪টি আর ২০১৬ সালে ১০টি।

এছাড়া ২০১৬ সালে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে অন্তত ২৪৫টি এবং বছরের শেষে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মোট আসামির সংখ্যা ছিল অন্তত ১৬৪৫জন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।