কারসাজি হওয়ায় নির্ধারিত দামের অর্ধেকে কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.06.18
ঢাকা
কারসাজি হওয়ায় নির্ধারিত দামের অর্ধেকে কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি ঈদের পরদিন মঙ্গলবার রাজধানীর লালবাগের পোস্তা এলাকায় লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণে ব্যস্ত আড়তের শ্রমিকরা। ১৮ জুন ২০২৪।
[সনি রামানী/বেনারনিউজ]।

সোমবার ঈদুল আজহার দিন কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কিছুটা সহনশীল থাকলেও মঙ্গলবার বাজারে ধস নামে।  ফলে সরকার নির্ধারিত দামের প্রায় অর্ধেকে কোথাও কোথাও কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের অনেকেই চামড়ার দাম কমে যাওয়ার জন্য বাজার কারসাজি, বিক্রির ভুল পদ্ধতি এবং মূল্য পরিশোধ না করার বিষয়গুলোকে দায়ী করেছেন।  এর সঙ্গে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়ার চাহিদা কমে যাওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন।

সরকার এ বছর প্রতি বর্গফুট চামড়া ৫৫ থেকে ৬০ টাকা দর ঠিক করে দেয়।  এই হিসেবে গরুর যে চামড়ার দাম এক হাজার থেকে ‌‌১১০০ টাকা হওয়ার কথা, সেই চামড়া স্থান ভেদে বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকায়।

ছাগল ও ভেড়ার চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ১০ টাকায়।  ফলে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অনেকেই ছাগল ও ভেড়ার চামড়া রাস্তা ও ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান চামড়ার দাম পর্যবেক্ষণ সম্পর্কিত সরকারি কমিটির প্রধান। তিনি বলেন, “চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ার মূল কারণ মৌসুমী ব্যবসায়ীদের ভুল পদ্ধতি এবং অদৃশ্য সিন্ডিকেট।”

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “দেশে এক দিনে এক কোটির বেশি পশু কোরবানি হয়।  এই বিপুলসংখ্যক চামড়া সংগ্রহ করে মৌসুমী ব্যবসায়ী, এতিমখানা, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন সংগঠন।  সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাঁরা যেন চামড়া সংগ্রহ করে সাথে সাথে ঢাকায় পোস্তার আড়তে না পাঠায়।  কারণ এখানে দিনে সর্বোচ্চ এক লাখ চামড়া প্রাথমিক প্রক্রিয়াজাতকরণ করা যায়।”

সফিকুজ্জামান বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঢাকার বাইরে থেকে কোনও চামড়ার ট্রাক ঢাকায় ঢুকবে না।  কিন্তু দেখা গেল, মঙ্গলবার সারা দেশ থেকে লাখ লাখ চামড়া পোস্তায় নিয়ে আসা হয়েছে।  আমাদের জানানো হয়েছে যে, পোস্তার ব্যবসায়ীরা ফোন করে চামড়া আনতে বলেছেন।”

তিনি বলেন, “এখন পোস্তার ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমাদের চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ করার সক্ষমতা নেই।  পুরো প্রক্রিয়ায় যোগান-চাহিদার মধ্যে  ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হওয়ায় দাম পড়ে গেছে।”

সফিকুজ্জামান বলেন, “কাঁচা চামড়া সরাসরি ঢাকা নিয়ে না এসে স্থানীয়ভাবে লবণ দিয়ে রাখলে তা তিন মাস পর্যন্ত নষ্ট হয় না।  সরকার সেটি করার পরামর্শ দিলেও  তারা কথা শোনেনি।”

তিনি বলেন, “এ কারণে লাখ লাখ চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে।  এটি জাতীয় সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছু না।”

মিরপুরের মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলম বেনারকে বলেন, “আমি যে চামড়া ৭০০ টাকায় কিনেছি, আড়তদারেরা সেই চামড়ার দাম বলেছে ২০০ টাকা।  তাদের সাফ কথা, এই দামে দিলে দেন, না দিলে নিয়ে যান।”

তিনি বলেন, “আমার মতো অনেকেই পথে বসার অবস্থায়।  হয় চামড়া ছেড়ে দিতে হবে, নতুবা ফেলে দিতে হবে।”

প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, সোমবার দেশে এক কোটি চার লাখের বেশি পশু কোরবানি হয়েছে, যা সারা বছর সংগৃহীত চামড়ার প্রায় ৭৫ ভাগ।

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “বিশ্বের কোথাও একদিনে এক কোটি চামড়া পাওয়ার নজির আছে বলে মনে হয় না।  পচনশীল হওয়ায় এগুলো খুব তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়।”

তিনি বলেন, “আড়তদাররা ট্যানারি মালিকদের কাছে কাঁচা চামড়া বিক্রি করেন।  ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা, মৌসুমী ব্যবসায়ীরা আড়তদারদের কাছে কাঁচা চামড়া বিক্রি করেন।  তারা সরাসারি ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করতে পারেন না।”

সাইফুল ইসলাম বলেন, “একটি বড় সমস্যা হলো ট্যানারি মালিকদের অনেকেই আড়তদারদের কাছে মাল নিয়ে পুরো টাকা দেন না।  বছরের পর পর বাকি রাখেন।  ফলে আড়তদাররা টাকা পায় না।  আড়তদাররা টাকা না পেলে তারা ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের টাকা দিতে পারে না।  দাম কমার এটাও একটি কারণ।”

তিনি বলেন, “ভারতে চামড়ার দাম বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।  ফলে বাংলাদেশ থেকে কাঁচা চামড়া ভারতে পাচারের চেষ্টা হবে।”

তবে সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিজিবি জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে চামড়া যেন পাচার না হয় সেজন্য সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

সাইফুল ইসলাম বলেন, “বাজারকে তার মতো চলতে না দিয়ে সরকার প্রতি বছর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু সেটি কার্যকর করা যায় না।”

লাভবান হচ্ছে চীন

অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ. মনসুর বেনারকে বলেন, “আমাদের দেশে যে পরিমাণ চামড়া উৎপন্ন হয় সেগুলোর অভ্যন্তরীণ চাহিদা সর্বোচ্চ ১০ ভাগ।  বাকি চামড়া বিদেশে রপ্তানি হতো।

“তবে আমরা ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাবারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প সরিয়ে নিলেও পরিবেশ দূষণের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাইনি।  লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকায় চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে বিক্রি করতে পারি না,” যোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক মনসুর বলেন, “সেকারণে আমাদের দেশে উৎপাদিত কাঁচা চামড়া (ওয়েট-ব্লু) মূলত চীন ও হংকংয়ে রপ্তানি করা হয়।  চীন আমাদের কাঁচা চামড়া কিনে তারা সেগুলোতে মূল্য সংযোজন করে চীনা বাজারে চীনা পণ্য হিসাবে বিক্রি করে।”

তিনি বলেন, “আমাদের চামড়া আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করে প্রস্তুত করা হচ্ছে। কিন্তু মূল সুবিধা নিচ্ছে চীন।  আমরা বুড়িগঙ্গা দূষিত করে ধ্বংস করেছি।  এখন হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে এখন সাভারে নিয়ে ধলেশ্বরী নদী ধ্বংস করছি।”

চামড়া শিল্প রক্ষায় কি করা দরকার এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের দুষণ বন্ধ করতে হবে।  এলডব্লিউজজি’র শর্ত মেনে চলতে হবে।  অন্যথায় চীন এই সুবিধা নিতেই থাকবে এবং আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকবো।”

এদিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা মঙ্গলবার ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুর বিসিক চামড়া শিল্পনগরী পরিদর্শন করেন বলে জানান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা ফয়সল হাসান।

সচিবের বরাত দিয়ে তিনি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মঙ্গলবার বলেন, এবার বিসিক চামড়া শিল্পনগরীর সিইটিপি পুরোপুরি প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দিয়ে তরল বর্জ্যকে পরিশোধন করা হয়েছে। তাছাড়া বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট ব্যবস্থা চালু রয়েছে।  প্রাথমিক পরিশোধন ছাড়া যাতে কোন ট্যানারির বর্জ্য সিইটিপি'তে আসতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে। 

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।