প্রবাসীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না আয়, হুন্ডিকে দায়ী করছে বাংলাদেশ ব্যাংক

রিয়াদ হোসেন
2023.12.21
ঢাকা
প্রবাসীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না আয়, হুন্ডিকে দায়ী করছে বাংলাদেশ ব্যাংক ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ২ নম্বর টার্মিনাল দিয়ে দেশে ফিরছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। ২৯ এপ্রিল ২০২০।
সুদীপ্ত সালাম, বেনারনিউজ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যা বাড়লেও প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না প্রবাসী আয়, বরং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তা কমতির দিকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ।  এই তিন মাসে আয় হয়েছে ৪৯১ কোটি ডলার।

প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার জন্য হুন্ডিসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক উপায়কে দায়ী করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “উপসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শ্রমিক যাওয়ার সংখ্যা বাড়লেও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে হুন্ডি এবং অন্যান্য অনানুষ্ঠানিক উপায়।”

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের অন্যতম বাজার সৌদি আরব থেকেই আলোচ্য সময়ে আয় কমেছে ১৮ শতাংশের বেশি।  অথচ গত কয়েক বছর ধরে প্রবাসীর সংখ্যা বাড়ছে।  

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া প্রবাসীর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ১০ হাজার। অথচ প্রবাসী আয় বৈধ পথে আনতে সরকার ডলারের বিনিময় হারের বাইরে বাড়তি প্রণোদনা দিয়ে আসছে ২০১৯ সাল থেকে।  প্রণোদনার পরিমাণ শুরুতে দুই শতাংশ থাকলেও পরবর্তীতে আড়াই শতাংশ করা হয়।

তবুও প্রত্যাশিত গতি না আসায় গত অক্টোবর মাসে ব্যাংকগুলোকে আরও আড়াই শতাংশ বাড়তি দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)।

অর্থাৎ কোনো ব্যাংক চাইলে বাড়তি ওই প্রণোদনার অর্থ নিজস্ব তহবিল থেকে দিতে পারবে, যা ইতোমধ্যে কিছু ব্যাংক বাস্তবায়ন করেছে।  

তা সত্ত্বেও প্রবাসী আয় প্রত্যাশিত হারে না আসার কারণ ব্যাখ্যা করে এবিবির সাবেক সভাপতি ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “এর মূল কারণ হুন্ডি।  কেননা হুন্ডি বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে।  এর বাইরে সম্প্রতি নির্বাচন কেন্দ্রিক সময়েও মানুষ টাকা দেশে আনার চেয়ে বিদেশে নিয়ে যাওয়া বা কাছে রেখে দেওয়া ঠিক মনে করেন।”

পাশাপাশি গত এক বছরের বেশি সময় ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে যাওয়া এবং আমদানি রপ্তানির ব্যয়ের ভারসাম্য কমে যাওয়ায় আর্থিক হিসাব নেতিবাচক হয়ে যাওয়াকেও দায়ী করেন তিনি।

হুন্ডির কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলো সরকার নির্ধারিত যে দরই দিক না কেন, হুন্ডিতে পাঠালে কিছু না কিছু বেশি পাওয়া যাবে।  হুন্ডিতে হাত দিতে না পারলে কিংবা রেমিট্যান্স বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বা আমাদের পক্ষে (ব্যাংকগুলো) তেমন কিছুই করার নেই।”

হুন্ডি অন্যতম কারণ বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরও।  হুন্ডির মাধ্যমে আসা অর্থের দরকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না বলে স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক।  বেনারকে তিনি বলেন, “ব্যাংক প্রবাসী আয়ে যে দরই দিক না কেন, হুন্ডিতে দুই টাকা বেশি থাকে।”

তবে হুন্ডিতে টাকা পাঠানো ঠেকাতে জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।  

মেজবাউল হক বলেন, “আগামীতেও এটি অব্যাহত থাকবে।” তিনি বলেন, সরকারের উদ্যোগের কারণে প্রবাসী আয় চলতি বছরের শেষ নাগাদ তা গত বছরের চেয়ে বেশি হবে আশা করা যায়।

গত প্রায় ৮ বছর ধরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের মোহাম্মদ ইমন হোসেন সৌদি আরবে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন, যিনি মাঝে মাঝে ব্যাংকের বাইরে হুন্ডিতে টাকা পাঠান।

এর কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, “ব্যাংকের পাঠালে যে টাকা পাই (প্রণোদনার অর্থসহ) তার চেয়ে প্রতি ১০০ টাকায় এক বা দুই টাকা বাড়তি পাই।  আবার আমি যার কাছে টাকা পাঠাই, সহজে তিনি পেয়ে যান।”

সংযুক্ত আরব আমিরাতে থাকা আত্মীয়র কাছ থেকে গত মাসে ২০ হাজার টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পেয়েছেন ঢাকার মিরপুরে বাস করেন এমন একজন পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “ব্যাংকের চেয়ে কিছুটা বেশি টাকা পাওয়া যায়।”

বাংলাদেশে কী পরিমাণ অর্থ হুন্ডিসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে দেশে আসে, তার বিশ্বাসযোগ্য কোনো পরিসংখ্যান নেই।  তবে গত বছরের আগস্টে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন,  যে পরিমাণ প্রবাসী আয় আসে, তার প্রায় অর্ধেক আসে অবৈধ উপায়ে বা হুন্ডিতে।

বাংলাদেশে গত দেড় বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যাপক হারে কমছে।  বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি, যা এক বছর আগে ছিল ৩৪ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের পরেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রবাসী আয়।  

বিশ্বব্যাংকের গত ১৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম, আর প্রথম স্থানে রয়েছে ভারত।  চলতি বছর প্রবাসী আয় ২৩ বিলিয়ন ডলার আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।  এ পরিস্থিতিতে প্রবাসী আয়ের রিজার্ভ বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখতে পারতো।

 ড. আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, “হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত কেউ স্থানীয় মুদ্রা বা ডলার দিলে বাংলাদেশে টাকা দেওয়া হয়।  এখানকার গ্রহণকারী টাকা পেলেন ঠিকই, কিন্তু ওই ডলার আর দেশে এলো না।  টাকা পাচারকারী বা অন্যরা ওই দেশ থেকে ডলার নিয়ে নেন।  

নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা আর দুর্নীতি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি প্রবাসী আয় বৈধপথে দেশে না আসার পেছনে নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা আর দুর্নীতি অন্যতম কারণ।

 ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তার কারণেও কিছু সংখ্যক মানুষ টাকা দেশে আনছেন না।  এর বাইরে দুর্নীতিও আরেক কারণ।  দুর্নীতি বাড়তে থাকলে মানুষ টাকা পাচার বাড়িয়ে দেয়; বাণিজ্যিক উপায়ে বা অন্য কোনো উপায়ে।

এছাড়া তরুণদের একটি অংশ দেশে আসছে না, বরং তারা দেশের সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কেন আসবে এ দেশে? বাংলাদেশ যদি তাদের কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্য না হয়! এখানে যদি গণতন্ত্র আর সঠিক নির্বাচনী ব্যবস্থা না থাকে, কর্মসংস্থান না থাকে আর পদে পদে অনিশ্চয়তা থাকে—তাহলে বাংলাদেশ তো তাদের কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্য হবে না।”

আগামী বছরও আশা নেই

বিশ্বব্যাংক বিশ্বব্যাংক মনে করছে, চলতি বছর বাংলাদেশে প্রবাসী আয় ২৩ বিলিয়ন ডলার হতে পারে এবং আগামী বছরও এর চেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

গত ১৮ ডিসেম্বর সংস্থাটির প্রকাশিত ‘মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্রিফ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এমন পূর্বাভাসের কথা উঠে এসেছে।

এতে বলা হয়, “সাম্প্রতিক সময়ে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট (আমদানি ও রপ্তানি আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য) সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ায় বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের কারণে বিকল্প বিনিময় হারের বাজার তৈরি হয়েছে, ফলে প্রবাসী আয় চলতি বছরের মতোই থাকতে পারে।

“মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা নীতির কারণে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার প্রবাসীরা কালোবাজারের সুবিধা নেওয়া এবং অনানুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক উপায়ে অর্থ লেনদেন করতে উৎসাহিত করেছে,” বলা হয় প্রতিবেদনে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।