রোহিঙ্গা শরণার্থীরা পুলিশি নির্যাতনের শিকার: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
2023.01.17
ঢাকা
শরণার্থী শিবিরে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) মঙ্গলবার ওয়েব সাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে এ অভিযোগ করেছে।
এপিবিএন-এর বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগের ভিত্তি নেই বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
এইচআরডাব্লিউ-এর দাবি, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে এপিবিএন চাঁদাবাজি, নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং ইতোমধ্যেই অপরাধী দল ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর সহিংসতার সম্মুখীন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হয়রানি করছে।
এই পরিস্থিতিতে দাতা দেশগুলোর উচিত রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের তদন্ত, ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দেওয়া, বলেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে ২০২০ সাল থেকে এপিবিএন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এপিবিএন দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে শরণার্থী শিবিরগুলোতে নির্যাতন বেড়েছে। পাশাপাশি শিবির এলাকায় নিরাপত্তার অবনতি হয়েছে।
এপিবিএন-এর হাতে গুরুতর নির্যাতনের ১৬টি ঘটনায় নথিভুক্ত পুলিশ রিপোর্ট পর্যালোচনা এবং গত বছরের অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে ৪০ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে এইচআরডব্লিউ এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অন্যরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে মাদক কিংবা অস্ত্র ব্যবসা অথবা বহনে জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ফাঁসানোর অভিযোগ তুলে আসছে।
এ প্রসঙ্গে এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া বিষয়ক গবেষক শায়না বাউচনার বলেন, “কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে যেসব বাহিনীর নিরাপত্তা দেওয়ার কথা তাদের হাতে নির্যাতনের ফলে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের উচিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অফিসারদের ব্যাপক চাঁদাবাজি এবং অন্যায়ভাবে আটকের অভিযোগ অবিলম্বে তদন্ত করা এবং দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা।”
নির্যাতন ও ঘুষের অভিযোগ
এইচআরডব্লিউ বলছে, নির্যাতনের বা ঘুষ আদায়ের প্রায় প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই এপিবিএন সরাসরি সম্পৃক্ত অথবা ক্যাম্পগুলোর স্থানীয় নেতাদের (মাঝি) মাধ্যমে এই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার না করার জন্য সাধারণত সংশ্লিষ্ট শরণার্থীর কাছে ৪০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত এবং গ্রেপ্তার কোনো ব্যক্তিকে ছেড়ে দিতে পুলিশ পরিবারগুলোর কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করে থাকে।
মামলায় জড়িত শরণার্থী পরিবারগুলোকে ঘুষের টাকা প্রদান বা মামলা পরিচালনার আইনি খরচ জোগাতে প্রায়ই সোনার গয়না বিক্রি করতে হয়, বলা হয় প্রতিবেদনে।
এইচআরডব্লিউ’র প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, এপিবিএন-এর নির্যাতনের তথ্য যারা অনলাইন প্লাটফর্মে শেয়ার করেন, তাদেরও নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
এ রকম কয়েকটি ঘটনা পাওয়া গেছে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে স্বাস্থ্য স্বেচ্ছাসেবক এবং একজন নাগরিক সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ২৭ বছর বয়সী সাঈদ হোসেন (নিরাপত্তার স্বার্থে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে) জানান, গত বছরের ২৫ জুলাই রাত ১০টার দিকে এপিবিএন’র প্রায় ৩০ সদস্যের একটি দল তাঁর বাড়িতে এসে তাঁকে হাতকড়া পরায় এবং তাঁর ল্যাপটপ ও ফ্ল্যাশ ড্রাইভ জব্দ করে।
সাঈদ আরও বলেন, পুলিশ তাঁকে বলেছে যে, একজন এপিবিএন কর্মকর্তা নিরপরাধ রোহিঙ্গাদের হয়রানি করার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে এমন কয়েকটি ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে দেখা গেছে—শরণার্থী শিবিরে যারা দোকান চালিয়ে আয় করেন, তাঁরা পুলিশের বিপুল অংকের ঘুষ দাবির শিকার হন। অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকেও রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরসা’র সদস্য বানিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়।
এইচআরডব্লিউ’র এই অনুসন্ধান সম্পর্কে কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মোহাম্মদ রফিক জানান, “এপিবিএন কিছু কিছু ক্ষেত্রে অকারণে ধরে টাকা (ঘুষ) দাবি করে। বিশেষ করে যেসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, তাঁরা বেশি হয়রানি শিকার হন।”
অভিযোগের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজারের বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ সৈয়দ বলেন, “আমার ক্যাম্পে এ ধরনের হয়রানির ঘটনা ঘটেনি। ক্যাম্পে মাঝিরা এপিবিএন-পুলিশকে সহায়তা করে এটা সত্য। তবে ঘুষ বা হয়রানির মতো ঘটনা ক্যাম্পে হয় না।”
এইচআরডব্লিউ’র অভিযোগ ভিত্তিহীন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। তিনি আরও বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন এবং আগামীতে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তা চিন্তার বিষয়। রোহিঙ্গারা আট থেকে ১০ জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া কেটে ফেলেছে। শেয়ালের মতো সুড়ঙ্গ পথ বানিয়ে নিয়েছে, যার মাধ্যমে বর্ডার ক্রস করে রোহিঙ্গারা ইয়াবা ব্যবসা করে।”
পুলিশ এসব অনিয়ম যখনই নিয়ন্ত্রণ করতে যায় তখনই এসব প্রশ্ন আসে দাবি করে তিনি বলেন, “এপিবিএন ওখানকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এপিবিএন নিয়ে এসব বলার মানে হচ্ছে, এমন আরেকটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাতে অবস্থা ঠিক না হয়।”
উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে সমুদ্রে নিখোঁজ রোহিঙ্গাদের সংখ্যা
নিজেদের মাতৃভূমি মিয়ানমার বা বাংলাদেশ থেকে পালাতে গিয়ে সমুদ্রে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘ মঙ্গলবার মিয়ানমারের মাতৃভূমি বা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার নিন্দা করেছে এবং সতর্ক করেছে যে সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়াই আরও বেশি মানুষ মারা যাবে।
মঙ্গলবার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জেনেভায় এই তথ্য জানিয়েছে বলে খবর প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
এতে বলা হয়, ২০২২ সালে বিপজ্জনক এই সমুদ্র যাত্রার সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজার, যা তার আগের বছর ২০২১ সালে ছিল ৭০০।
জাতিসংঘের মুখপাত্র শাবিয়া মান্টু জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন, “ইউএনএইচসিআর মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির হিসাব যেভাবে রেকর্ড করেছে তা উদ্বেগজনক। ২০২২ সালে সমুদ্রে অন্তত ৩৪৮ জন মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন, যা ২০১৪ সালের পর সবচেয়ে মারাত্মক বছরগুলোর মধ্যে একটি।”
তিনি বলেন, গত বছর সমুদ্রপথে পালানোর চেষ্টা করা তিন হাজার ৪০ রোহিঙ্গা প্রাথমিকভাবে মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশে থেকে পালানোর পথে পা দিয়েছেন যাদের ৪৫ শতাংশ নারী ও শিশু।
প্রতিবেদন তৈরিতে কক্সবাজার থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান।