শূন্য রেখার মিয়ানমার অংশে গোলাগুলি, বাড়িঘরে আগুন

কামরান রেজা চৌধুরী ও আব্দুর রহমান
2023.01.18
ঢাকা ও কক্সবাজার
শূন্য রেখার মিয়ানমার অংশে গোলাগুলি, বাড়িঘরে আগুন বান্দরবান জেলার তুমব্রু এলাকায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গা শিবিরে আগুনের ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ছবিটি নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে ধারণ করা ভিডিও থেকে নেয়া। ১৮ জানুয়ারি ২০২৩।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

কয়েক মাস শান্ত থাকার পর বুধবার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বান্দরবান জেলার তুমব্রু পয়েন্টে আবারও গোলাগুলির ঘটনায় হামিদ উল্লাহ নামে একজন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।

সীমান্তের শূন্য রেখায় মিয়ানমার অংশে শুরু হওয়া সহিংসতায় এক রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

বুধবার সন্ধ্যায় বেনারকে তিনি বলেন, “আমরা খবর পেয়েছি ‍তুমব্রু সীমান্ত এলাকার শূন্য রেখার মিয়ানমার অংশে সংঘর্ষ হয়েছে, বাংলাদেশ অংশে নয়।”

“ওই ঘটনায় একজন নিহত হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। শূন্যরেখায় বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

ওই ঘটনায় দুই রোহিঙ্গা আহত হয়েছেন বলে পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তাঁরা হলেন; টেকনাফের জাদিমুড়া ক্যাম্প-২৬ এর মুহিব উল্লাহ (২৫), ঘুমধুম জিরো পয়েন্টের শিশু মোহাম্মদ হোসেন (১২)।

দু’পক্ষের গোলাগুলিতে শূন্যরেখায় অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

শূন্যরেখার রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, এর আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সংঘাত হয়েছিল। এবার মিয়ানমারের রাখাইনভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন।

তবে এ বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

শূন্যরেখা বরাবর মিয়ানমার অংশে সাড়ে চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করেন।

প্রাণ ভয়ে তুমব্রু পয়েন্ট হয়ে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় নতুন করে কয়েকজন রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় নেতারা।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেনারকে বলেন, “চার থেকে পাঁচজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশ অংশে ঢুকে পড়েছে। আমরা তাদের আটক করেছি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আগামীকাল তাঁদের নিজ বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে।”

সংঘর্ষে কারা জড়িত এমন প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান খান বলেন, “আমরা যতটুকু খবর পেয়েছি, আরসা এই ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে। ওদের বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ রয়েছে। ওরাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে।”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “বিজিবি সীমান্তে সক্রিয় রয়েছে। আশা করি সমস্যা হবে না।”

আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ

স্থানীয় অধিবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার ভোর পাঁচটা থেকে হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়।

কক্সবাজার পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “সীমান্তে গোলাগুলিতে নিহত হামিদ উল্লাহর মৃতদেহ উখিয়ার কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে রাখা হয়। সেখানে গুলিবিদ্ধ শিশুসহ আহত আরো দুইজন চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।”

বুধবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেছে, শূন্যরেখা রোহিঙ্গা শিবিরে আগুন লাগায় নারী শিশুসহ প্রায় ৩০ জন রোহিঙ্গা নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখান থেকে তাঁদের তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যান স্থানীয় লোকজন।

এ সময় শূন্যরেখা রোহিঙ্গা শিবিরের কিশোরী আসমা বলেন, “আমাদের সবার ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। সবাই এদিক-ওদিক পালাচ্ছে। সকাল থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত গোলাগুলি চলেছে। শূন্যরেখায় বোমা ফেলছে, একজন মারা গেছে। আবার অনেকে আহত হয়েছে।”

প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশের এদিকে ছুটে এসেছেন উল্লেখ করে শূন্যরেখার বাসিন্দা মো. রহিম জানান, “সীমান্তে গোলাগুলির এক পর্যায়ে শিবিরে হঠাৎ করে আগুন জ্বলতে থাকে। মানুষজন সেখানে থাকতে পারছে না। তাই আমরা এখানে পালিয়ে এসেছি।”

তুমব্রু সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ আতিকুল ইসলাম জানান, শূন্যরেখা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়ায় নারী-শিশুসহ ৩০ থেকে ৪০ রোহিঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সামনে জড়ো হয় আহাজারি করছিল। পরে আমিসহ স্থানীয় লোকজন মিলে তাদের তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যাই।”

বিষয়টি স্বীকার করে বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বেনারকে বলেন, “ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তে শূন্যরেখায় মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোর মধ্যে গোলাগুলি চলছে। সীমান্তে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত পরে জানানো হবে।”

গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার অংশে সেদেশের সেনাবাহিনী এবং স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে প্রায় দুই সপ্তাহব্যাপী সংঘর্ষ চলে। ওই সংঘর্ষে মিয়ানমার অংশ থেকে মর্টার শেল তুমব্রু সীমান্তে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে পড়ে।

এই ঘটনায় বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কয়েক দফা প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে মর্টারশেল পড়ায় মিয়ানমারের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়। তারা জানায়, ভুলবশত মর্টারশেল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে পড়েছিল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।