'মিয়ানমারের বিদ্যমান আইন' মেনে ফিরতে হবে রোহিঙ্গাদের

কামরান রেজা চৌধুরী ও তুষার তুহিন
2018.01.22
কক্সবাজার
উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে পরিবারের সদস্যদের বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্র দেখাচ্ছেন এক রোহিঙ্গা শরণার্থী উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে পরিবার সদস্যদের বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্র দেখাচ্ছেন এক রোহিঙ্গা শরণার্থী। ২২ জানুয়ারি ২০১৮।
কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ

‘প্রত্যাবর্তন স্বেচ্ছামূলক’ এবং ‘মিয়ানমারের বিদ্যমান আইন মেনে চলার অঙ্গীকার’সহ একটি ডকুমেন্ট সই করেই প্রত্যাবাসী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখাইনে ফিরতে হবে। বেনারনিউজের সংগ্রহ করা প্রত্যাবাসন ফরম এর একটি কপি থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

ইংরেজি ভাষায় পাঁচ পৃষ্ঠার এই ফরমটিতে ফেরত যেতে আগ্রহী সব পরিবারের পাঁচ বছরের বেশি বয়সী সদস্যদের নাম লিখতে হবে।

প্রত্যাবাসন ফরমে প্রত্যেক পরিবার প্রধানকে তাঁর বাবা, মা, স্বামী অথবা স্ত্রীর নামসহ মিয়ানমারে তাঁদের ঠিকানা লিখতে হবে।

এছাড়া যাচাইকরণ ফরমের সঙ্গে প্রতিটি পরিবারের একটি পারিবারিক ছবি এবং প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের বায়োমেট্রিক তথ্য সম্পৃক্ত করতে হবে।

তবে ফরমটি পূরণ করার জন্য এখনো বিতরণ শুরু হয়নি। এদিকে কখন প্রত্যাবাসন শুরু হবে সে কথা এখনই বলা যাচ্ছে না বলে বেনারকে জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম।

“প্রত্যাবাসন একটি জটিল প্রক্রিয়া। তাই ঠিক কবে থেকে প্রত্যাবাসন শুরু হবে এমন নির্দিষ্ট তারিখ আমরা দিতে পারি না। তবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারব বলে আমরা আশা করছি,” বলেন মোহাম্মদ আবুল কালাম।

গত বছর নভেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার মধ্যে স্বাক্ষরিত রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবাসন ২২ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়ার কথা।

এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া "পিছিয়ে দেবার" বাংলাদেশি সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গাদের “সাময়িক স্বস্তি” দিয়েছে বলে এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনেকেই বলেছেন, মিয়ানমার সরকার তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ঘোষণা না দিলে তারা রাখাইনে ফেরত যাবেন না।

“আমরা শুনেছি যে, বাংলাদেশ আমাদের ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করেছে। আমরাও নিজ দেশে ফিরতে চাই, তবে অবশ্যই মিয়ানমারকে আমাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। তারা যদি সেটা দেয়, তাহলে আরাকানে আমরা ফেরত যাব,” বেনারকে বলেন কুতুপালং শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা লাল মোহাম্মদ (৬৫)।

এদিকে শুক্রবার শরণার্থী শিবিরগুলোতে কয়েক শ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পূর্বে তাঁদের একুশ দফা দাবি নিশ্চিত করার জন্য বিক্ষোভ করেছে।

এইসব দাবির মধ্যে রয়েছে মিয়ানমারে নাগরিকত্বসহ শিক্ষা ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার।

প্রসঙ্গত, পূর্বে বার্মা নামে পরিচিত বর্তমান মিয়ানমারে শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসলেও ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়।

সরকারের সাথে আলোচনায় শরণার্থী সংস্থা

শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “গত ১৫ জানুয়ারি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠকে আমরা প্রত্যাবাসন যাচাইকরণ ফরমটি চূড়ান্ত করেছি। এতে একটি নতুন সেকশন রয়েছে যেখানে বলা আছে তাঁরা (রোহিঙ্গা) মিয়ানমারের বিদ্যমান আইন মেনে চলবে এবং তাঁরা কারও প্ররোচনা ছাড়াই স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফিরছে।”

কমিশনার বলেন, “এই ঘোষণাটা আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘোষণাই সাক্ষী দেয় যে, আমরা তাঁদের জোরপূর্বক পাঠাচ্ছি না।”

তিনি বলেন, এখন মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের যাচাইয়ের জন্য এক লাখ রোহিঙ্গার তালিকা তৈরির প্রথম পদক্ষেপটি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ।

“পরিবার অনুযায়ী প্রত্যাবাসন হবে। তাই আমরা যাচাইয়ের জন্য পরিবার অনুযায়ী শরণার্থীদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করব,” বলেন কালাম।

তালিকাটি মিয়ানমার সরকারের কাছে যাবে প্রথম যাচাইয়ের জন্য। এরপর বাংলাদেশ তাঁদের জিজ্ঞাসা করবে, তাঁরা প্রত্যাবাসনে রাজি কিনা।

“এরপরেই আমরা প্রত্যাবাসী রোহিঙ্গাদের যাচাইকরণ ফরম পূরণের জন্য লোক নিয়োগ করব। পূরণ করা সেই ফরমগুলো মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে দ্বিতীয় ভেরিফিকেশনের জন্য দেওয়া হবে। তারপর প্রত্যাবাসনে আগ্রহীরা নির্ধারিত পয়েন্ট দিয়ে নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়বে,” বলেন কমিশনার কালাম।

তিনি জানান, সরকার প্রত্যাবাসন ফরম পূরণ করতে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর–এর সঙ্গে চুক্তি সই করতে পারে।

এদিকে ইউএনএইচসিআর–এর একজন মুখপাত্র বেনারকে জানান যে, তাঁরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য সরকারের কাছ থেকে একটি প্রস্তাব পেয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তা বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনার চালিয়ে যাচ্ছি।”

এদিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার প্রস্তুতির জন্য আরো সময় প্রয়োজন বলে সোমবার জেনেভা থেকে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি।

“সঠিক, টেকসই এবং কার্যকর প্রত্যাবাসনের জন্য অনেকগুলো বিষয়ে নজর দিতে হবে, যেগুলো সম্পর্কে আমরা কোনো আলোচনাই শুনতে পাচ্ছি না, বিশেষ করে নাগরিকত্ব, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের অধিকারসহ স্বাধীনভাবে চলাফেরার স্বাধীনতা, কাজকর্ম ও জীবনধারণের সুযোগ সুবিধা,” বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেন ফিলিপ্পো গ্রান্ডি।

আমরা প্রস্তুত: মিয়ানমার

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দেরি হতে পারে এ ধরনের কোনো তথ্য বাংলাদেশের কাছ থেকে পায়নি বলে জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার।

এ প্রসঙ্গে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর আং সান সু চির দপ্তরের মহাপরিচালক জ তে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেন, “শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হবে কি না সে বিষয়ে বাংলাদেশের আমাদেরকে জানানো প্রয়োজন। যদি প্রক্রিয়াটি দেরি হয় তবে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার জন্য দুই দেশের আলোচনা করা উচিত।”

তিনি বলেন, “শরণার্থীদের গ্রহণ, তথ্য যাচাই, তাঁদের খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা, সকল বিষয়েই আমরা প্রস্তুত। শরণার্থী গ্রহণকেন্দ্র এবং তাঁদের জন্য অস্থায়ী আবাসনও তৈরি। সরকারি কর্মকর্তা এবং জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্যরাও প্রস্তুত, যদিও বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করেনি।”

“শরণার্থীদের ফিরে আসার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার আমাদের সাথে যোগাযোগ না করলেও আমরা মিয়ানমার-বাংলাদেশের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী কাজ চালিয়ে যাব,” বলেন জ তে।

২০১৬ সালের অক্টোবর ও গত বছর আগস্ট মাসের পর রাখাইন রাজ্যে অব্যাহত সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য গত ২৩ নভেম্বর নেপিদোতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সু চি’র দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তিন্ত সোয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

ওই চুক্তি অনুসারে, ২৩ নভেম্বর থেকে দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা। অর্থাৎ ২২ জানুয়ারি সোমবার প্রথম ব্যাচের রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার কথা ছিল।

এদিকে ২৫ আগস্টের পর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ৬ লাখ ৮৮ হাজার বলে জানিয়েছে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা ত্রাণ সংস্থাগুলোর জোট আইএসসিজি।

এক প্রশ্নের জবাবে কমিশনার কালাম বলেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশকে জানিয়েছে যে, প্রত্যাবাসন শুরু করার আগে তারা রাখাইন থেকে এদেশে রোহিঙ্গা প্রবেশ বন্ধ করবে।

“আমরা এমন তথ্য পেয়েছি যে রোহিঙ্গারা এখনও আসছে। এটা বন্ধ করা উচিত,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।