সাগর পথে পালাতে গিয়ে এক বছরে ৫৬৯ রোহিঙ্গা নিখোঁজ
2024.01.23
ঢাকা ও কক্সবাজার
বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে সাগরপথে অবৈধভাবে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টাকালে গত বছর অন্তত ৫৬৯ জন রোহিঙ্গা নিখোঁজ হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা বিষয়ক ইউএনএচসিআর।
মঙ্গলবার জেনেভায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র ম্যাথিউ সল্টমা এই তথ্য জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের মতে, ২০২৩ সালে প্রায় সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পথে যাত্রা করেছিলেন, যা আগের বছরগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেশি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, নিখোঁজ বা মৃত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ২০১৪ সালের পর থেকে এটিই সর্বোচ্চ।
সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী ২০২২ সালে আন্দামান সাগর এবং বঙ্গোপসাগরে ৩৯টি নৌকায় সমুদ্রপথে যাত্রা করেন। তাঁদের মধ্যে কমপক্ষে ৩৪৮ জন মারা যান বা নিখোঁজ হয়েছিলেন।
যাত্রা শেষ করে ৬৪ শতাংশ রোহিঙ্গা ইন্দোনেশিয়ায় গেছেন।
ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুসারে, এই রোহিঙ্গাদের সিংহভাগই বাংলাদেশ থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন, বাকিরা মিয়ানমার ও অন্যান্য দেশ থেকে।
সংবাদ সম্মেলনের পরে এ সংক্রান্ত বিবৃতিতে বলা হয়, গত বছরের নভেম্বরে আন্দামান সাগরে নৌকা ডুবে প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
“এই পরিসংখ্যানগুলো যে বাস্তবতা সামনে নিয়ে আসে, তা হচ্ছে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলো বাঁচার জন্য কাজ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। সময় মতো উদ্ধার ও নিরাপদ স্থানে নামার সুযোগ না পাওয়া এবং উপকূলীয় এলাকায় কঠোর নজরদারির ফলে প্রচুর মানুষকে প্রাণ দিতে হচ্ছে,” বলা হয় বিবৃতিতে।
ভবিষ্যতে এই ধরনের ট্র্যাজেডি কমাতে আঞ্চলিক উপকূলীয় কর্তৃপক্ষকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর।
সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে সাগর পথে পালানোর এই প্রবণতার পেছনে শরণার্থী শিবিরগুলোতে জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা হ্রাস ও সহিংসতা বৃদ্ধিকে কারণ মনে করেছেন শরণার্থীরা।
‘উন্নত জীবনের আশায়’ সাগরযাত্রা
সাগরপথে বিপজ্জনক যাত্রার অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন দুজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে কথা হয় বেনারের।
বর্তমানে বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা সৈয়দ আলম বলেন, “ক্যাম্পের যে রেশন পাই তা দিয়ে সংসার ঠিক মতো চলে না। আর প্রতিনিয়ত সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে। তাই পরিবারের অভাব দূর করার পাশাপাশি উন্নত জীবনের আশায় ক্যাম্প থেকে বের হয়ে দালালের মাধ্যমে সাগরপথে মালয়েশিয়া রওয়ানা দিয়েছিলাম।”
যাত্রাপথের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “ক্যাম্প থেকে বের হয়ে টেকনাফের একটি পাহাড়ে পাঁচ দিন ছিলাম। প্রথমে ছোট নৌকা নিয়ে একটু গভীর সাগরে থাকা ট্রলারে উঠি। আমার মতো অনেকেই ছিলেন নৌকায়। মাঝিরা ইন্দোনেশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সাগরে তিন দিন ঘুরতে থাকে।
“এক পর্যায়ে কূলের কাছাকাছি এসে মাঝি-মল্লারা ট্রলার রেখে পালিয়ে যায়। পরে দুটি নৌকা আমাদের ট্রলারটি টেনে কূলে নিয়ে আসে। ট্রলারে শুধু শুকনো খাবার, আর সামান্য পানি দেওয়া হতো,” বলেন তিনি।
ব্যর্থ হয়ে ক্যাম্পেই ফিরে আসতে হয় আলমকে।
তিনি আরও বলেন, “দালালকে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। বাকি দুই লাখ টাকা ইন্দোনেশিয়া পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল।”
আলমের মতোই গত বছরের নভেম্বর মাসের শেষে মালয়েশিয়ায় পালাতে গিয়ে ব্যর্থ হন উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা মুহাম্মদ হামিদ হোসেন।
তিনি বলেন, “ক্যাম্পের কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি পেতে সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলাম কিন্তু সে যাত্রা সফল হয়নি।”
ক্যাম্পে খাবারের কষ্ট জানিয়ে তিনি বলেন, “আগের মতো ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে কাজের সুযোগ কম।”
পরিবারের ছয় সদস্য নিয়েই মালয়েশিয়ায় যাত্রা করেছিলেন হামিদ। আলমের মতো একইভাবে প্রতারণার শিকার হন তিনি।
হামিদ আক্ষেপ করে বলেন, “আমাদের আর এই ক্যাম্পের জীবন ছাড়া হয়নি।”
শিবির অনিরাপদ, খাদ্যের অভাব
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবায়ের বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা অনিরাপদ এবং খাদ্যের অভাবে কষ্টের জীবন পার করছে। এ জীবন থেকে মুক্তি পেতে রোহিঙ্গারা যেদিকে সুযোগ পাচ্ছে সেদিকে পালাচ্ছে।”
উন্নত জীবনের আশায় সাগরপথে মালয়েশিয়ায় যাত্রা বন্ধ হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, “সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জেনেও চুপ করে আছে, কারণ রোহিঙ্গারা মারা গেলেও কারও কিছু যায়-আসে না।”
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য অনুসারে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সাগর থেকে এক হাজার ১৩৪ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। তাঁরা অবৈধভাবে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন।
এসব ঘটনায় উখিয়া ও টেকনাফ থানায় এক হাজার ২০০ জনকে আসামি করে ৮৫টি মামলা করা হয়েছে। আটক হয়েছেন ৫০৮ জন পাচারকারী।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমরা মানব পাচার রোধে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। অনেকে স্বেচ্ছায় দালালদের মাধ্যমে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়।”